ন্যাভিগেশন মেনু

অগ্নিঝরা মার্চের ৩০তম দিন:

পাকবাহিনী বাঙ্গালি নিধনে মত্ত, ভারত বাড়িয়ে দেয় সাহায্যের হাত


৩০ মার্চ ১৯৭১। বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ ও হানাদার বাহিনীর প্রতিরোধ পূর্ব বাংলায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরের মতো অন্য শহর ও গ্রামেও পাকিস্তানি হায়েনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। অপরদিকে ‘যার যা আছে তাই নিয়ে’ বীর বাঙালি স্থানে স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

এদিন পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিকামী নিরস্ত্র জনগণের উপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী উদ্বেগ ও নিন্দা প্রকাশ করে বিবৃতি দেন। তিনি তাদের পার্লামেন্টে বলেন, “পূর্ব বঙ্গের সাড়ে সাত কোটি লোক তাদের স্বাধীনতার জন্য যে সংগ্রাম শুরু করেছেন, ভারত তাকে সাহায্য না করে পারে না। ভারত তাই সংগ্রামে সাহায্য করেই যাবে।”

২৯ মার্চ দিবাগত রাতে অন্যদিনের তুলনায় ঢাকায় গোলাগুলি শব্দ খুব একটা শোনা যায়নি।

সকালে সরকারি প্রেস ট্রাষ্টের মালিকানাধীন দ্য মর্নিং নিউজ (The Morning News) এক পৃষ্ঠায় খবর ছেপে আরেক পৃষ্ঠা সাদা রেখেই প্রকাশ করে।

এদিনও সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ তুলে নেওয়া হয়। শহর ছেড়ে মানুষের গ্রামে যাওয়া থামেনি। শুধু ডেমরা আর কেরানীগঞ্জের পথেই লাখো মানুষ ঢাকা ছেড়ে যায় গত ৩ দিনে।

৩০ মার্চ দ্বিতীয়দিনের মতো কেরানীগঞ্জ এলাকায় বিছিন্নভাবে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিবিনিময় চলতে থাকে।

এদিন তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে সঙ্গী করে কুষ্টিয়া জেলার ভারতীয় সীমান্তবর্তী টুঙ্গি গ্রামের এক সেতুর নিচে আশ্রয় নেন। এখানে বসেই তাজউদ্দীন আহমদ সিদ্ধান্ত নেন যে তারা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবেই ভারতে ঢুকবেন।

চট্টগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতারের দুপুরের অধিবেশন শেষ হবার পরে পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর প্লেনে বোমাবর্ষণ করে কালুরঘাট বেতার ট্রান্সমিশন এন্টেনাসহ ভবনের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। তবে কেউ হতাহত হয়নি। এদিন থেকে চট্টগ্রাম  পাকসেনা দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। নৌবাহিনীর গোলাবর্ষণও চলতে থাকে। রাতে কার্যত চট্টগ্রাম শহর হানাদার বাহিনীর দখলে চলে আসে। এদিন ও এর পরের কয়েকদিন চট্টগ্রামের লালখান বাজারে পাকসেনা, বিহারি এবং রাজাকাররা মিলে হত্যা করে প্রায় আড়াই হাজার বাঙালি। এদিন ‘ওয়াসার মোড়ের কল হতে পানি দেওয়া হচ্ছে’ এমন গুজব রটিয়ে জড়ো করা হয় বাঙালিদের। এরপর পাকিস্তানি সেনারা নির্মমভাবে গুলিকরে হত্যা করে শত শত বাঙালিকে। এরপর ওইদিন দুপুর থেকে বাঙালা দেখামাত্রই গুলি করে হত্যা করতে থাকে হানাদাররা। রাতেই চলে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মানুষ হত্যা। চট্টগ্রামের লালখান পুরো মৃত্যুপুরী হয়ে ওঠে।

সন্ধ্যায় কমান্ডার মতিন পাটওয়ারীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন দখল করে নেয়।

এই দিন নাটোরের লালপুরে ‘ময়নার যুদ্ধে’ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সুদৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলে সাঁওতাল ও বাঙালিরা। এই সম্মুখযুদ্ধে সাঁওতাল তীরন্দাজসহ ৪০ জন বাঙালি শহীদ হন। সেদিন মুক্তিপাগল জনতা, তৎকালীন ইপিআর ও আনসার বাহিনীর হাতে পর্যুদস্ত হয় ২৫নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট।

ময়নার যুদ্ধের সময় তিনটি জেট বিমান আকাশে চক্কর দিতে থাকে। একটি হেলিকপ্টার থেকে খাদ্য ও রসদ যোগান দেয় হানাদারদের। এই যুদ্ধে ৪০ জন শহীদ হলেও ১৫ জন শহীদের নাম সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। অপরদিকে ক্ষেতের মধ্যে তীর ও গুলিবিদ্ধ ৭ জন পাকিস্তানি সেনার লাশও পাওয়া যায়। কেবল তা-ই নয়, যুদ্ধে পর্যুদস্ত হয়ে হানাদার সেনারা রাতের আঁধারে ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পালাতে থাকে। এর পরদিন পাশের ধান ও গম ক্ষেতসহ বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানী বাহিনীর নেতৃত্বদানকরী মেজর রাজা আসলামসহ কয়েকজন ধরা পড়ে। পরে তাদের নিয়ে এসে লালপুর এস এস পাইলট হাইস্কুল মাঠে এক সংক্ষিপ্ত বিচারের পর গুলি করে হত্যা করা হয়। সেই সাথে বিলুপ্ত হয় ২৫ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট।

৩০ মার্চ পাকিস্তানা হানাদার বাহিনী রংপুর সেনানিবাসের আশেপাশের এলাকায় হামলা করে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করে এবং ধর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞ চালায়।

[তথ্যসুত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ]

এডিবি/