ন্যাভিগেশন মেনু

অগ্নিঝড়া মার্চের ২৪তম দিন:

বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া বৈঠক বাতিল, পাকিস্তানি সেনাদের বাঙালি নিধন শুরু


২৪ মার্চ ১৯৭১। এদিন থকেই মূলত বাঙ্গালি নিধনের নিল নকশার বাস্তবায়ন শুরু করে পাকিস্তান সরকার। এদিন সৈয়দপুর, রংপুর, চট্টগ্রাম ও ঢাকার মিরপুরে বিহারীদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা শত শত নিরীহ মুক্তিকামী বাঙ্গালিকে নির্বিচারে গুলিচালিয়ে হত্যা করে। বাতিল হয় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের চলমান বৈঠক।

এইদিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যকার পূর্বনির্ধারিত বৈঠকটি বাতিল হয়ে যায়।

২৪ মার্চ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সমাগত মিছিলকারীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই। আগামীকালের মধ্যে সমস্যার কোনো সমাধান না হলে বাঙালি নিজেদের পথ বেছে নেবে। আমরা সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। কোনো ষড়যন্ত্রই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। বাংলার জনগণের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হলে তা বরদাস্ত করা হবে না।’ 

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কোনো রক্ত চক্ষু সহ্য করা হবে না। আমি কঠোর সংগ্রামের জন্য বেঁচে থাকবো কিনা জানি না। আমি যদি আপনাদের নির্দেশ দিতে না পারি তবে আপনারা আরও দৃঢ়তার সাথে ৭ কোটি বাঙালির মুক্তির জন্যে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের মতো স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকবো, নয়তো সংগ্রামে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো।’

২৩ মার্চ রাত থেকে ২৪ মার্চ সকাল পর্যন্ত পাকসেনাবাহিনী সৈয়দপুর সেনানিবাসের পার্শ্ববর্তী বোতলাগাড়ী, গোলাহাট ও কুন্দুল গ্রাম ঘেরাও করে অবাঙালিদের সাথে নিয়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এতে শতাধিক নিহত এবং অসংখ্য মানুষ আহত হয়। শহরে কারফিউ দিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্য এবং অবাঙালিরা সম্মিলিতভাবে বাঙালির বাড়িঘরে আগুন দেয় এবং হত্যা অভিযান চালায়।

রংপুর হাসপাতালের সামনে ক্ষুব্ধ জনতা ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে পাকসেনারা রংপুর সেনানিবাস সংলগ্ন এলাকায় নিরস্ত্র অধিবাসীদের ওপর বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণ করে। এখানেও অর্ধশতাধিক নিহত এবং বহু আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।

মিরপুরে অবাঙালিরা সাদাপোশাকধারী পাকসেনাবাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় বাঙালিদের বাড়িঘরের শীর্ষে ওড়ানো বাংলাদেশের পতাকা এবং কালো পতাকা নামিয়ে জোর করে তাতে আগুন দেয় এবং পাকিস্তানি পতাকা তোলে। রাতে বিহারীরা এখানে ব্যাপক বোমাবাজি করে আতঙ্কের সৃষ্টি করে।

এদিন করাচি থেকে এমভি সোয়াত নামের একটি জাহাজ আসে। এতে পাঁচ হাজার ৬৩০ টন অস্ত্র আনা হয়। চট্টগ্রামে পাক সেনারা বন্দরের ১৭নং জেটিতে নোঙর করা এই জাহাজ থেকে সমরাস্ত্র খালাস করতে গেলে হাজার হাজার বীর বাঙালি ও মুক্তিকামী বন্দরশ্রমিকরা তাদের ঘিরে ফেলে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা জাহাজ থেকে কিছু অস্ত্র নিজেরাই খালাস করে ১২টি ট্রাকে করে নিয়ে যাবার সময় জনতা পথরোধ করে। সেনাবাহিনীর ব্যারিকেড দেওয়া জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে দুই শতাধিক শ্রমিক শহীদ হন।

সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগ ও সরকারি উপদেষ্টা পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন। এ বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষ হতে ফেডারেশনের পরিবর্তে ‘কনফেডারেশন’ নামটি প্রস্তাব করা হয়। সরকারি দল এর প্রতিবাদ করে বলে, এটা আওয়ামীদলের নীতিগত মৌলিক পরিবর্তন। আওয়ামীদল নিজ অবস্থান সমর্থনে বলে, অন্য সব কিছু অপরিবর্তিত থাকলে নামের পরিবর্তন কোন মৌলিক পরিবর্তন নয়। এ সময় সরকারি আইন বিশেষজ্ঞ কর্নেলিয়াস ‘কনফেডারেশন’ এর স্থলে ‘ইউনিয়ন’ শব্দটি প্রস্তাব করেন। আওয়ামী লীগ বলে, এ বিষয়ে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হোক মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকে। বৈঠকে দুপক্ষ খসড়া সংবিধানের সব অনুচ্ছেদ ও তফসিলের উপর দফাওয়ারী আলোচনা শেষ করেন। দু’ঘন্টা স্থায়ী বৈঠক শেষে তাজউদ্দিন আহমেদ উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আমাদের বক্তব্য আমরা উপস্থাপন করেছি। আলোচনা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আর আলোচনার প্রয়োজন নেই। এখন প্রেসিডেন্টের উচিত তার ঘোষণা দেওয়া।

এদিন শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে খান আব্দুল ওয়ালী খান বৈঠক করেন।

পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভূট্টো দুপুরে প্রেসিডেন্ট ভবনে জেনারেল ইয়াহিয়া ও তার উপদেষ্টাদের সাথে বৈঠক করেন। তিনি বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি অত্যন্ত করুণ ও দুর্ভাগ্যজনক। এ অঞ্চলের শোষিত জনগনের প্রতি আমার অনেক ভালোবাসা রয়েছে। আমি তাদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমার একটি জাতীয় দায়িত্ব রয়েছে। আমি পাকিস্তান অখণ্ড রাখার জন্য জীবন দান করতে প্রস্তুত।

এদিকে ইয়াহিয়া খানের আমন্ত্রণে পাকিস্তান থেকে খান আবদুল কাইয়ুম খান ঢাকায় আসেন। কাইয়ুম ঢাকা আসার পরই ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে এক বৈঠকে বসেন।

টিভি কেন্দ্রে প্রহরারত সৈন্যরা টিভি কর্মীদের সাথে দুর্ব্যবহার করলে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে ঢাকা টিভির কর্মীরা টিভির সব ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার থেকে বিরত থাকেন।

এদিন মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাস সফর করে এবং ব্রিগেড কমান্ডারদের সাথে বৈঠক করেন।

চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বাঙালী ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদারকে ঢাকায় বদলি করে সেখানে ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে নিযুক্ত করে।

স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র গণবিপ্লবকে আরও জোরদার করার জন্য সংগ্রামী বাংলার জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

সাংবাদিকরা এক জরুরি সভায় মিলিত হয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হয়রানিমূলক আচরণের তীব্র নিন্দা জানান।

২৪ মার্চ থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা একে একে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট ছোট পার্লামেন্টারি দলের সব নেতাই এদিন কারাচির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। ভুট্টোর সফরসঙ্গী ১৩ জনের সাতজনই এদিন করাচি চলে যায়।

পূর্বপাকিস্তান রাইফেলসের সদর দপ্তর যশোরে বাঙালি অফিসাররা সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করেন। রাইফেলসের জওয়ানরা ‘জয় বাংলা-বাংলার জয়’- গান গাইতে গাইতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার প্রতি পূর্ণ সামরিক কায়দায় গার্ড অব অনার জানিয়ে ফ্ল্যাগ স্যালুট করেন। ভোলা ও বগুড়ায়ও রাইফেলসের জওয়ানরা নিজ নিজ ছাউনিতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।

[তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ১৯৭১ সালে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে]

এডিবি/