বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে ভারতে নারী পাচারে হাতবদল হয় ৮ বার। ঢাকা থেকে ভারতের কলকাতা, মুম্বই, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, দিল্লি বা অন্য যেকোনস্থানে তরুণীদের পাচারের সময় আটবার হাতবদল করা হয়। কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা পায়ে হেঁটে, কখনো মোটরসাইকেলে করে, আবার কখনো ঝোপ-জঙ্গলে লুকিয়ে রেখে, বড় রাস্তায় উঠে গাড়িতে করে এবং সর্বশেষ আকাশপথে তাদের গন্তব্যস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়।
দুই দিনের এই চলার পথে অন্তত তিনবার গণধর্ষণের শিকার হতে হয় এই তরুণী-কিশোরীদের। এ কাণ্ড চক্রের সদস্যরা ভিডিও করে রেখে দেয়। নির্যাতিত নারীরা প্রতিবাদ করতে গেলে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেওয়ার ভয়ভীতি দেখানো ছাড়াও ভিডিও নেটে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।
পাচার করে নিয়ে যাওয়া নারীদের বাসা বাড়িতে আটকে রাখা হয়। এখান থেকেই তাদের নিয়ে যাওয়া হয় বিভিন্ন হোটেলে। এসব হোটেলে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাদের। সেখানে এক দিনে ৩০ জনের সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য করা হয় তাদের। এ অবস্থায় অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার অভাবে মানবেতর জীবন-যাপনও করছেন অনেকেই। বাংলাদেশে ফিরে আসা তরুণী জানান, প্রথম দিনেই ১৯ জনের সঙ্গে যৌন কর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়। এরপরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
টিকটকারদের নারী পাচারকান্ডের পুলিশি তদন্তে এমন সব ভয়ঙ্কর তথ্য বেরিয়ে আসার পর পুলিশ প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছে। পুলিশ বলছে, টিকটক স্টার বানানো এবং বিভিন্ন সুপারশপে ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে কয়েক হাজার কিশোরী তরুণীকে ভারতে পাচার করা হয়েছে। তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আর এই ভয়ঙ্কর পাচারচক্রের সাতজন ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছে। ভারতের বেঙ্গালুরুতে গ্রেফতার হয়েছে ছয়জন।
টিকটকের স্টার বানানো এবং বড় কোনো সুপারশপে চাকরি দেওয়ার নামে টিকটকার হৃদয় বাবু, বস রাফি, মেহেদী বাবুসহ সিন্ডিকেটের সদস্যদের ভয়াবহ জাল ছড়ানো সারা দেশে। বিভিন্ন জেলা থেকে তরুণী ও কিশোরীদের ফাঁদে ফেলে পাচার করা হচ্ছে। এভাবেই হৃদয় বাবু ফাঁদে ফেলে ঢাকার শাহজাহানপুরের এক তরুণী শ্যামলীকে (ছদ্মনাম)। তাকে কুষ্টিয়ায় টিকটক হ্যাংআউটের কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয় সাতক্ষীরায়।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারির ঘটনা এটি। সাতক্ষীরা বাসস্ট্যান্ড থেকে একটি মোটরসাইকেলে করে চলে যায় আরও ভিতরে। সেখানে একটি বাড়িতে ভাড়া থাকার কথা বলে রাখে। তিন কক্ষের বাড়িটির মালিক আলম। সেখানে তার স্ত্রী ও দুই সন্তান থাকে। হৃদয় ও শ্যামলী বাড়িতে ঢোকার কিছুক্ষণ পর হৃদয়ের সমবয়সী আরও তিন তরুণ ও লাবণী (ছদ্মনাম) নামের ২২ বছর বয়সী এক নারী আসে। তাকে দেখে শ্যামলী ভাবে, তার মতোই টিকটকের শখ হয়তো আছে লাবণীর। শ্যামলী ও লাবণীকে একটি কক্ষে থাকতে দেওয়া। হৃদয় ও অন্য তিন তরুণ অন্য কক্ষে ঘুমান।
রাত আড়াইটার দিকে হৃদয় রুমের দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে ওই তরুণীকে দরজা খুলতে বলে। লাবণী এবং শ্যামলীর ঘুম ভাঙে। দরজা খুলে দিলে হৃদয় ও ৩০-৩৫ বছর বয়সী আনিস নামে এক লোককে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। আনিস তাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ ঘুরিয়ে দেখে চলে যায়।
এরপর ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে হৃদয় আবার রুমের দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে তাদের ডেকে তুলে। দরজা খুলে দেখেন হৃদয়সহ লাবণীর সঙ্গে আসা অন্য তিন তরুণ রুমের সামনে দাঁড়ানো। হৃদয় ও সেই তিন তরুণ তাদের দ্রুত রুম থেকে বের হতে বলে। তারা দ্রুত বের হয়ে দৌড়ে বেশ দূরের একটি বাড়িতে চলে যান। সেই বাড়িতে গিয়ে তারা ছয়জন একটি রুমে ঢোকামাত্রই হৃদয় দরজা বন্ধ করে দেয়।
ওই দিন সকাল ৮টার দিকে ৫০ থেকে ৫৫ বছর বয়সী আবদুল কাদের নামে এক লোক ছয়জনের নাস্তা নিয়ে আসেন। সামনেই ভারতের সীমান্ত। প্রাকৃতিক দৃশ্য নাকি খুব সুন্দর। এই এলাকায় এলে কেউ সেখানে না ঘুরে ফেরে না। দুপুর ১২টায় আবদুল কাদের দুই সেট ছেঁড়া জামাকাপড় নিয়ে এসে দুই তরুণীকে পরতে বলে।
ছেঁড়া জামাকাপড় না পরলে নাকি ভিতরে যাওয়া যায় না। প্রায় ১০-১৫ মিনিট পর দুটি লাল মোটরসাইকেল নিয়ে ২৫-৩০ বছর বয়সী দুজন পুরুষ লোক আসে। এরা হল- মেহেদী হাসান বাবু ও মহিউদ্দিন। মেহেদীর বাবা আবদুল কাদের। এরপর হৃদয়, ভুক্তভোগী ওই তরুণী, লাবণী, লাবণীর সঙ্গে আসা তিন তরুণ, মেহেদী হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও আবদুল কাদের সীমান্তের দিকে হাঁটতে থাকে।
১০-১৫ মিনিট হাঁটার পর এক জায়গায় দেখেন আরও চারটি মেয়ে এবং ৩০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী হারুন নামে এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। আনিস ও আবদুল কাদের এবং লাবণীর সঙ্গে থাকা তিন ছেলে চলে যায়। মেহেদী হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও হারুনের সঙ্গে হৃদয়সহ তারা ছয়জন হাঁটতে থাকেন। ৩০-৪০ মিনিট হাঁটার পর ভারতীয় সীমান্তের সামনে তারা বসে পড়েন। এরপর হৃদয় তাকে জানায়- ভারতীয় সীমানায় ঢুকে সে তার সঙ্গে সেলফি তুলবে।
জমি ও খেতের আইল দিয়ে প্রায় দুই-তিন ঘণ্টা হাঁটার পর ট্রাউজার পরা ওই ব্যক্তি লুঙ্গি পরা একজনের কাছে তাদের বুঝিয়ে দিয়ে চলে যায়। লুঙ্গি পরা লোকটির সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টা হাঁটার পর এক জায়গায় গিয়ে ওই তরুণী চারটি মোটরসাইকেলসহ চারজনকে পান। হৃদয় ওই তরুণীকে কালো রঙের একটি মোটরসাইকেলে উঠতে বলেন।
মোটরসাইকেলের চালকের নাম বকুল ওরফে ছোট খোকন। খোকন জোরে মোটরসাইকেল চালাতে থাকেন। শ্যামলী ভয় পেয়ে ঢাকায় ফিরতে চাইলে হৃদয় তাকে জানান- কোনো ভয় নেই। তিনিও ঢাকাতেই ফিরবেন। ১০ থেকে ১৫ মিনিট যাওয়ার পর একটি টিনশেড বাসার সামনে খোকন মোটরসাইকেল থামায়। মিনিট পাঁচেক পর অন্য একটি মোটরসাইকেলে চড়ে লাবণী আসে। লাবণী এবং ওই শ্যামলীকে ওই বাসায় রেখে হৃদয় আর খোকন মোটরসাইকেলে করে বাইরে যান।
সেই বাসার একজন মহিলা শ্যামলীকে এবং লাবণীকে খাবার ও জামাকাপড় দেন। খাবার খেয়ে তারা ঘুমিয়ে পড়েন। রাতে খোকন এসে লাবণীকে নিয়ে যান। ঘণ্টাখানেক পর খোকন ওই শ্যামলীকে একটি অন্ধকার রুমে নিয়ে যান। সেই অন্ধকার রুমে লাবণীও ছিল। তারা দুজনই চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন।
কাঁদতে কাঁদতে লাবণী তাকে জানায়, মুম্বাইয়ে তার দূরসম্পর্কের চাচার বাসায় যাওয়ার জন্য এই পথে এসেছেন। তাকে সেখানে ধর্ষণ করা হয়। এভাবে আরও কয়েকটি বাড়ি পরিবর্তন করা হয়। এরপর হৃদয় ও ছোট খোকন দুজন মিলে শ্যামলীকে ধর্ষণ করে। সেখান থেকে লাবণী এবং শ্যামলীকে আধার কার্ড এবং বেঙ্গালুরুগামী বিমানের টিকিট ধরিয়ে দেয় খোকন। হৃদয়, শ্যামলী ও লাবণী ইনডিগো এয়ারলাইনসের ফ্লাইটে বেঙ্গালুরু যান।
বিমানবন্দরে তাদের রিসিভ করে সবুজ ও রুবেল নামে দুজন। বিমানে আসা তিনজনকে আনন্দপুরা সার্কেলে রুবেল তার বাসায় নিয়ে যান। সেখানে রুবেল ও তার স্ত্রী সোনিয়া থাকেন। শ্যামলীকে ওই বাসায় ১০ দিন রাখা হয়। এরপর তাদের দুজনকে সেখানে পালাক্রমে ধর্ষণ করতে থাকে। এরই মধ্যে গত ২৭ মার্চ হৃদয় শ্যামলীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে চান।
কিন্তু শ্যামলী বাধা দেওয়ায় তাকে মারধর করা হয়। ৪-৫ দিন পর তাকে জানানো হয় ‘কাজে যেতে’ হবে। অস্বীকৃতি জানালে তাকে হৃদয়, সাগর ও সবুজ মিলে আবার মারধর করে। শ্যামলী চিৎকার করে কাঁদতে থাকলে সেখানেই তাকে ধর্ষণ করে সবুজ। সাগর ও হৃদয় ভিডিও ধারণ করে। এরপর হদয় তাকে জানায় তাদের কথা মতো না চললে, এই ভিডিও সবাইকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
৩-৪ দিন পর শ্যামলীকে মাইক্রোবাসে করে চেন্নাইয়ের একটি হোটেলে নেওয়া হয়। সেখানে এক দিনে ১৯ জনের সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য করা হয় মেয়েটিকে। অসুস্থ হয়ে হোটেলের কর্মীদের হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করেও ছাড়া পাননি বলে জানায় মেয়েটি। তাকে আবার আনন্দপুরার সেই বাসায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়। সেই বাসায় ঢুকে মেয়েটি দেখে হৃদয় ঢাকা থেকে আরও চার তরুণীকে নিয়ে এসেছেন। ওই মেয়েরা তার সঙ্গে একই ঘরে থাকত।
এক রাতে ধর্ষণে বাধা দিলে একটি মেয়ের মাথায় মদের বোতল দিয়ে আঘাত করেন হৃদয়। মেয়েটির ক্ষতস্থানে চারটি সেলাই দিতে হয়। এরপর শ্যামলীকে একটি ‘ম্যাসাজ পারলারে’ কাজের জন্য ঢাকায় ফিরে আসা মেয়েটিকে পাঠানো হয়। এক রাতে বেঙ্গালুরু ও হায়দরাবাদ থেকে দুটি মেয়ে পালিয়ে যান। শ্যামলী পালানোর চেষ্টা করেন, তবে ধরা পড়ে যান।
সেখানে ‘কাজ করা’ অবস্থাতেই শ্যামলী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে পারলারের লোকজন তাকে আনন্দপুরার বাসায় রেখে যায়। দুই দিন পর ওই হোটেল থেকে পালাতে সক্ষম হয় মেয়েটি। ৭ মে তিনি বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করেন।
এস এস