ন্যাভিগেশন মেনু

বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে দিনাজপুরে তাঁতশিল্প


দিনাজপুরে তাঁত শিল্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনা, সুদক্ষ তাঁত শিল্পী, সহজলভ্য শ্রমিক থাকা সত্ত্বেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়া, বাজারজাতের অভাব এবং প্রয়োজনীয় উপকরণের সূতা-রঙ দফায় দফায় মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এই শিল্প আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। ফলে এ শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন কয়েক বছর ধরে। বর্তমানে যে কয়টি তাঁত চালু অবস্থায় রয়েছে সেগুলোও চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সেগুলোও বন্ধ হয়ে যেতে পারে যে কোন সময়।

গ্রামীণ ঐতিহ্য আর ইতিহাসের অনন্য একটি অংশ তাঁতশিল্প। দেশের বৃহত্তর একটি জনগোষ্ঠী এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। একসময় এ পেশাটিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বেশি জড়িত ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ্ব পর্যন্ত এ পেশা তারাই ধরে রেখেছিল। তখন তাদের বলা হতো আশ্বিনী তাঁতী। আমাদের দেশে এ পেশাজীবীদের বিভিন্ন উপাধিও রয়েছে। যেমন বারাশ, বসাক, নন্দী, পাল, প্রামাণিক, সাধু, সরকার, শীল ইত্যাদি।

১৯২০ সালের প্রথমার্ধে শহরে তাঁতীদের থেকে ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির একদল তাঁতী পূর্ববঙ্গে এসে আবাস গাড়েন। তাদেরই আসল তাঁতী বংশোদ্ভুত বলে গণ্য করা হয়।

পরবর্তী সময়ে মুসলমানরাও এই পেশায় জড়িয়ে পড়ে। তারা নিজেদের কারিগর বলতে পছন্দ করেন। আর সেখান থেকেই বোধহয় সৃষ্টি দিনাজপুর চিরিরবন্দর রাণীবন্দর এলাকার কারিগরি পাড়ার।

কারিগরি নামটি শুনলেই বোঝা যায় এখানে কারিগরদের বাস। এ পাড়াতে ৪০ থেকে ৫০টি ঘর রয়েছে। যাদের সবারই প্রধান জীবিকাই হচ্ছে এ হস্তচালিত তাঁত। এখানে শুধু লুঙ্গি তৈরি হয়। প্রযুক্তির বিকাশ যখন তাঁতীদের অনেকে জীবন ধারণের দ্বিতীয় উপায় হিসেবে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন তখনও কারিগরি পাড়ার লোকজন এর উপরই জীবিকা নির্বাহ করছেন। দিন দিন মানুষ যেখানে উন্নতির মুখ দেখেন, সেখানে এ পেশাজীবী মানুষরা রয়েছে অনেক পিছিয়ে। যদিও দিন দিন তাদের তাঁতের সংখ্যা বাড়ছে তবুও জীবনযাত্রার মান রয়েছে সেই আগের জায়গায়।

দিনাজপুরের চিরিরবন্দর ও খানসামা উপজেলার ১৩টি গ্রামে তদানিন্তন ব্রিটিশ আমলে গড়ে উঠে বৃহত্তর রাণীরবন্দর তাঁতশিল্প অঞ্চল। সেই থেকে তাঁত সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে রাণীরবন্দরের পরিচিতি ছিল দেশ জুড়ে।

এখানকার সুদক্ষ তাঁতশিল্পীদের হাতে তৈরি শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, তোয়ালে, মশারি এবং গুলটেক্স চাঁদর জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হতো। ফলে এ অঞ্চলে গড়ে উঠে ছোট-বড় প্রায় দুই শতাধিক তাঁতশিল্প। এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ১০ হাজার মানুষ।

কিন্তু সূতার দাম বৃদ্ধি পাওয়া এই শিল্প ধ্বংসের মুখোমুখী দাঁড়িয়েছে বলে জানান একজন তাঁত ব্যবসায়ী।  তাঁত শ্রমিকরা জানান, একটি শাড়ি তৈরি করে মজুরি পাওয়া যায় ৫০ টাকা। সারাদিনে তিনটি শাড়ি তৈরি করে আয় হয় দেড়'শ টাকা। সামান্য এই আয় দিয়ে অগ্নিমূল্যের বাজারে আমাদের সংসার আর চলছে না।

পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া এ পাড়ার পুরুষদের প্রধান পেশা তাঁতবস্ত্র তৈরি। বাড়ির মহিলারাও সংসারের অন্যান্য কাজের সঙ্গে এ কাজে ব্যস্ত থাকে। পুরুষরা সামান্য কিছু সময় অবসর নিতে পারলেও যেন মহিলাদের ভাগ্যে তা জোটে না। সংসারের সচ্ছলতা আনতে নারী-পুরুষ এক হয়ে কাজ করে যাচ্ছে,তবুও সচ্ছলতা আনতে পারছে না। শিক্ষার দিক থেকেও এগুতে পারছে না।

স্থানীয় একজন বলেন, ‘পেটে মোর ভাতই জোটে না, পড়াশোনা করামু কেমন করি।’ তবুও তারা দিন-রাত কাজ করে ভাগ্যের পরিবর্তন করতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। আগের দিনে হস্তচালিত তাঁতের সাহায্যে তাঁতবস্ত্র তৈরির জন্য চরকার বা সুতাকাটার টাকু ব্যবহার করা হতো। আজকাল পর্যাপ্ত পরিমাণে সুতা মেশিনে তৈরি হচ্ছে। পরিণতিতে চরকা প্রায় অবলুপ্ত হতে চলেছে। তবুও ঐতিহ্য ধরে এ পাড়ার কারিগররা চালিয়ে যাচ্ছে চরকা।

এখানে একটি পরিবার দিনে সর্বোচ্চ চারটি লুঙ্গি তৈরি করেন। আর এসব লুঙ্গি মহাজনদের কাছে বিক্রি করে ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। মহাজনরা তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে আরও বেশি টাকা দামে তা বিক্রি করে করে থাকেন। এতে মহাজনরা লাভের মুখ দেখলেও কারিগররা বঞ্চিত হচ্ছে তাদের পরিশ্রমের যথাযোগ্য লাভ থেকে।

তাঁতশিল্পী মোঃ আব্দুর রহমান বলেন, আমাদের দুর্দশা এমনই যে এরশাদ সরকারের আমলে নেওয়া ঋণ এখনও শোধ করতে পারিনি। বর্তমানে আমরা সরকারেরও কোনও সহযোগিতা পাচ্ছি না। এমনি চললে মসলিনের মতো হস্তচালিত তাঁতও একদিন ইতিহাস হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, নিজেদের কাজ এগিয়ে নিতে তাই সাহায্য নিতে হয় বিভিন্ন এনজিওদের। সেখান থেকে এনজিওরা তাদের ফায়দা লুটে নিলেও শিক্ষার অভাবে ঋণকৃত অর্থের সঠিক ব্যবহারে ব্যর্থ হচ্ছে তারা। এই অঞ্চলে বড় এনজিওগুলো চড়া সুদে ঋণ দেয়। যা শোধ করতে গেলে মাঝে মাঝে তৈরিকৃত লুঙ্গি আরও কম দামে বিক্রি করতে হয়।

এএস/সিবি/এডিবি/