ন্যাভিগেশন মেনু

ভাওয়াইয়া সন্ধ্যায় দর্শক-শ্রোতার মন মাতালেন মোস্তাফিজ পরিবারের শিল্পীরা


‘রঙ্গে রসে ভরপুর, হামার বাড়ি রংপুর, হামার ওত্তি যান, হামার আইগন্যাত বসি তোমরা শুনি আইসেন ভাওয়াইয়্যা গান…।’  রাজধানীর বুকে ঐতিহ্যবাহী ভাওয়াইয়া গানের এমনই আবেদন নিয়ে তিন ঘন্টা ধরে দর্শকদের মাতিয়ে রাখলেন মোস্তাফিজ পরিবারের ভাওয়াইয়া শিল্পীরা। দেশে এটিই একমাত্র পরিবার, যেখানে পরিবারের সবাই প্রথিতযশা ভাওয়াইয়া শিল্পী। 

ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমদের ৬৩তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গত ২৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সংগীত ও নৃত্যকলাকেন্দ্র মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় মোস্তাফিজ পরিবারের তৃতীয় ভাওয়াইয়া সন্ধ্যা। ভাওয়াইয়া গানের শিক্ষা, সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও গবেষণার বিশেষায়িত জাতীয়ভিত্তিক সংগঠন ভাওয়াইয়া অঙ্গনের আয়োজনে এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর।

বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ এবং অরবিস ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর ডা. মুনীর আহমেদ।

ভাওয়াইয়া সন্ধ্যা উদ্বোধন করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছ। আব্বাসউদ্দীনের শিল্পী জীবন ও ভাওয়াইয়ার প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা আব্বাসউদ্দীনের ভাগ্নে অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব কবি সরকার মাহবুব। সভাপতিত্ব করেন অবসরপ্রাপ্ত সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান।

একের পর এক সমবেত, দ্বৈত ও একক ভাওয়াইয়া গান গেয়ে শোনান একই পরিবারের চার সদস্য একেএম মোস্তাফিজুর রহমান, সালমা মোস্তাফিজ, সাহস মোস্তাফিজ ও মনিফা মোস্তাফিজ মন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন পরিবারের পুত্রবধু ডা. সাবিকুন নাহার সুমি।

ভাওয়াইয়া পরিবার সম্পর্কে ভাওয়াইয়া অঙ্গনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক একেএম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমি এমন একটি পরিবার গড়তে চেয়েছিলাম, যেই পরিবারের সবাই ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দীনের পথ অনুসরণ করে ভাওয়াইয়াকে ধারণ করবে। এই পরিবারের সকলেই বেতার, টেলিভিশন, অডিও ক্যাসেট ও মঞ্চে ভাওয়াইয়া পরিবেশন করেন। দুই বাংলায়ই এরকম পরিবার আর দ্বিতীয়টি নেই।’

ভাওয়াইয়া পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা একেএম মোস্তাফিজুর রহমান এ দেশে ভাওয়াইয়া বিষয়ক সংগঠন প্রতিষ্ঠার পথিকৃত হিসেবে সমাদৃত। তাঁর লেখা ও সুরারোপিত গানের সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি।

‘আয়শার মায়ের পাইস্যা হারাইছে’, ‘বুড়্যা কানে শোনে কম’, ‘ও মুই অমপুর গেইলে’সহ অসংখ্য বিখ্যাত ভাওয়াইয়া গানের রচয়িতা তিনি। সালমা মোস্তাফিজ গান গাইবার পাশাপাশি গীতিকার হিসেবেও সুনাম কুড়িয়েছেন। এ দেশে ভাওয়াইয়া গানে খুব অল্প সংখ্যক নারী গীতিকার রয়েছেন।

পুত্র সাহস মোস্তাফিজ শিশু বয়সেই ভাওয়াইয়ার বিষ্ময় বালক হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। তাঁর গাওয়া ভাওয়াইয়া গানের দুটি ক্যাসেট সারা দেশে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল। দেশে কোনো শিশুর ভাওয়াইয়া গানের প্রথম ক্যাসেট সাহসেরই। দেশে-বিদেশে সহস্রাধিক মঞ্চে ভাওয়াইয়া গেয়েছেন সাহস। কন্যা মনিফা মোস্তাফিজ এ সময়ের জনপ্রিয় শিল্পী। ক্ষুদে গানরাজ, সুর দরিয়া বাঘা গায়েন ও আইপিডিসি আমাদের গানে গান গেয়ে ও দোতরা বাজিয়ে তিনিজনপ্রিয় হয়েছেন। বাজারে রয়েছে তাঁর ভাওয়াইয়া গানের সিডি ‘মুই রংপুরের চেংড়ি।’

ভাওয়াইয়া সন্ধ্যায় শিল্পীরা গেয়ে শোনান নানা তালের ও নানা স্বাদের চটকা, ক্ষীরল, দরিয়া ও দীঘলনাশি ভাওয়াইয়া। অনুষ্ঠান শুরু হয় অতিথি ও দর্শকবৃন্দের আগমনী শুভেচ্ছা নিয়ে লেখা ভাওয়াইয়া গেয়ে।

এরপর আব্বাসউদ্দীন আহমদকে নিবেদন করে সমবেত কন্ঠে গেয়ে ওঠেন, ‘আব্বাসউদ্দীন তোমার তুলনা নাই, তোমার সুরে সুর মিলিয়্যা হামরা ভাওয়াইয়া গান গাই।’

শিল্পীরা একে একে গেয়ে শোনান ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই’, ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে’, ‘ঘাটাত দেখলে পোড়ায় মন’, ‘তোমরা গেইলে কি আসিবেন’, ‘রংপুরিয়্যা চ্যাংড়া বন্ধুরে’, ‘আজি ভাল করিয়া বাজানরে দোতরা’, ‘রংপুরিয়্যা ভাওয়াইয়া গান মনের হাউসে কই’সহ ২৮ টি ভাওয়াইয়া গান। মঞ্চে ভাওয়াইয়া গানের গবেষণাধর্মী ত্রৈমাসিক সাময়িকী ‘ভাওয়াইয়া’-এর বিশেষ সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করা হয়।