ন্যাভিগেশন মেনু

ভারতেই রয়েছে- ধর্ম-রাজনীতি চর্চাহীন শহর, ‘সেবার বদলে সেবা’


কল্পনা করা যাক এমন এক পৃথিবীর কথা, যেখানে আলাদা আলাদা দেশ নেই! নেই কোনও ধর্মও! নীলগ্রহের সব মানুষ একসঙ্গে ভালবেসে মিলেমিশে বাস করে নীল আকাশের নিচে।

ভূগোলের সীমা সেখানে কোনও বিভেদ তৈরি করে না। ধর্ম গড়ে তোলে না কোনও পাঁচিল। জন লেনন তাঁর ‘ইমাজিন’ গানে এমনই এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলেন। গানের শেষে কিংবদন্তি শিল্পী জানিয়ে দিয়েছিলেন, আমাকে আপনারা স্বপ্নচারী বলতে পারেন। কিন্তু আমি একা নই। একদিন সকলে ঠিক যোগ দেবেন আমার সঙ্গে। গড়ে তুলবেন এক অনন্য পৃথিবী।

কিন্তু এ তো কেবলই স্বপ্নের কথা। বাস্তব নয়। অথচ বাস্তবের ধুলোমাটির দুনিয়াতেই রয়েছে এমন এক শহর, যেখানে ধর্মের বিভিন্নতা নেই। কার্যত টাকার লেনদেনও নেই। নেই কোনও রাজনৈতিক আবহও। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যিই রয়েছে এমন এক শহর।

আর সেটা রয়েছে আমাদের এই ভারতেই! যার সঙ্গে আবার জড়িয়ে আছে এক বঙ্গসন্তানের নাম!

হেঁয়ালি সরিয়ে খুলেই বলা যাক। এই ছোট্ট শহরের নাম অরোভিল (Auroville)। তামিলনাডুর ভিলুপ্পুরম জেলার মধ্যে অবস্থিত হলেও এর কিছুটা অংশ আবার রয়েছে কেন্দ্রশাসিত পুদুচেরির ভিতরে।

অরোভিলের পত্তন হয়েছিল গত শতকের ছয়ের দশকে। নেহাতই কাকতালীয়, লেননের ‘ইমাজিন’ও ওই সময়ের আগে-পরেই রচিত। ‘বিটলস’-এর গায়ক কি জানতে পেরেছিলেন গোটা পৃথিবী না হোক, অন্তত এই গ্রহের এক টুকরো অংশে কিছু মানুষ একত্রিত হয়েছেন যাঁরাও তারই মতো ‘ড্রিমার’।

যে বঙ্গসন্তানের উল্লেখ আগে করা হয়েছে, তাঁকে বাঙালি মাত্রেই চেনে। ঋষি অরবিন্দ ঘোষ। ১৯২৬ সালে পণ্ডিচেরিতে (আজকের পুদুচেরি) স্থাপিত হয়েছিল ‘শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম’।

তবে রাজনৈতিক নেতা থেকে আধ্যাত্মসাধনা এবং দর্শনের পথে এগিয়ে চলা অরবিন্দ বেশিদিন আশ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে থাকেননি। শিষ্যা মীরা আলফাসা, যিনি পরবর্তী সময়ে ‘মাদার’ নামেই প্রসিদ্ধ হন, তাঁকে সব দায়িত্ব দিয়ে তিনি অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন।

সেই থেকে অরবিন্দের স্বপ্নকে সত্যি করার দায়ভার গিয়ে পড়ে ‘মাদারের’ই উপরে। তাঁর মনে হয়েছিল অরবিন্দের নির্দেশিত পথে চলতে গেলে এমন জনপদ প্রয়োজন, যেখানে সমমনস্ক মানুষরা একত্রিত হতে পারবেন।

এই চিন্তা থেকেই জন্ম নেয় অরোভিল। ব্রিটিশ স্থপতি রজার অ্যাঙ্গারের পরিকল্পনায় ১৯৬৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সালে পত্তন হয় শহরের। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গিয়েছে পাঁচ দশক।

এই মুহূর্তে অরোভিলের জনসংখ্যা ২ হাজার ৮১৪। ৫০টির বেশি দেশের বিভিন্ন বয়স, বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির মানুষেরা সেখানে একসঙ্গে বাস করেন।

অরোভিল ধর্মীয় বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে সত্যের সেবায় বিশ্বাস করে। শহরের একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে এক মন্দির, যার নাম ‘মাতৃমন্দির’।

সব মানুষই এখানে একত্রিত হয়ে ধ্যানে অংশ নেন। আলাদা করে কোনও নির্দিষ্ট ধর্মীয় আচরণের কোনও চিহ্ন এখানে নেই। একই ভাবে, এখানে নেই কোনও রাজনৈতিক কাঠামোও।

কোনও রাজনৈতিক দল এখানকার প্রশাসন চালায় না। শহরের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক বাসিন্দারা প্রশাসনের অংশ। তাঁরাই একত্রিত হয়ে সমস্ত সিদ্ধান্ত নেন। এই বছরই পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি তামিলনাডু ও পুদুচেরিতেও নির্বাচন। অথচ দুই রাজ্যকে ছুঁয়ে থাকা অরোভিল এক অন্য জগতের শহর যেন!

এখানকার অর্থনীতিও বিস্ময়কর। ‘সেবার বদলে সেবা’ নীতি অনুসরণ করে চলে এখানকার নগদবিহীন অর্থনীতি। সেই কোন প্রাগৈতিহাসিক আমলে আদিম মানুষরা যখন একটু একটু করে গড়ে তুলছেন সভ্যতা ও সমাজ, তখন প্রচলিত ছিল বিনিময় প্রথা।

সেই প্রথারই এক আধুনিক রূপ গড়ে তুলেছে অরোভিল। প্রত্যেক বাসিন্দার একটি করে অ্যাকাউন্ট নম্বর রয়েছে। যেটি আবার শহরের কেন্দ্রীয় অ্যাকাউন্টের সঙ্গে যুক্ত। প্রতি মাসেই অনুদান দিতে হয় বাসিন্দাদের। তবে কেবল অর্থ নয়, শ্রমের বিনিময়ও অনুদান হিসেবে গণ্য হয়।

আসলে শুরুতেই ‘মাদার’ জানিয়ে দিয়েছিলেন, এখানে অর্থের কোনও বিনিময় হবে না। কেবল মাত্র বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে টাকা ব্যবহৃত হবে। তাঁর স্বপ্ন ছিল, অর্থ এখানকার ‘সার্বভৌম ঈশ্বর’ হয়ে উঠবে না।

বস্তুগত সম্পদ আর সামাজিক অবস্থানের চোখরাঙানি বন্ধ করাই তাঁর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল। তবে বাইরে থেকে এখানে এলে অতিথিদের একটি অরোকার্ড দেওয়া হয়। যা কার্যত এখানকার ডেবিট কার্ডের সমতুল।

প্রথম দিকে শহরের সব নিয়ন্ত্রণ ছিল ‘শ্রী অরবিন্দ সোসাইটি’র হাতে। কিন্তু ১৯৮০ সাল থেকে শহরটির প্রশাসন ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে দেশের সরকার ‘অরোভিল ফাউন্ডেশন’-এর ম্যানেজের দায়িত্বে থাকলেও গোটা বাজেটের অল্প পরিমাণই সরকার দেয়। অরোভিলের বাণিজ্যিক ইউনিটগুলি থেকেই আসে বাজেটের মূল অর্থ। মুনাফার ৩৩ শতাংশ অরোভিলের কেন্দ্রীয় তহবিলে অনুদান হিসেবে জমা পড়ে৷

শহর জুড়ে রয়েছে ৪০ রকমের শিল্পের সংস্থান। পুদুচেরি-সহ দেশের বিভিন্ন অংশ, এমনকী বিদেশেও বিক্রি হয় এখানে তৈরি নানা পণ্য। রয়েছে রেস্তরাঁ, অতিথি নিবাস। এমনকী নিজস্ব ই-মেল নেটওয়ার্কও।এইভাবেই গত কয়েক দশক ধরে ধীরে ধীরে বেড়েছে এখানকার জনসংখ্যা।

গোটা পৃথিবীকেই যেন এক যৌথ খামারের স্বপ্ন দেখায় অরোভিল। লেননের গান ছুঁয়ে স্বপ্নচারীদের দেখা মেলে যে শহরে।

সূত্র : সংবাদ প্রতিদিন

এস এস