ন্যাভিগেশন মেনু

অগ্নিঝরা মার্চের ২৭তম দিন:

ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ ছুটে আপনজনের সন্ধানে, স্বাধীনতার পক্ষে ভারতের সমর্থন


২৭ মার্চ ১৯৭১। ২৬ মার্চ সারাদিন ঢাকা শহরের এখানে সেখানে চলতে থাকে গুলি। রাতের আঁধার নেমে আসার সাথে সাথে গোলাগুলির আওয়াজও বাড়তে লাগলো। ২৭ মার্চ ভোর পর্যন্ত প্রধান জল্লাদমঞ্চ হলো পুরানো ঢাকা অলিগলি। এছাড়া মিরপুর, মহাম্মদপুরেও চললো পাকসেনা আর অবাঙালিদের নারকীয় তাণ্ডব।

২৭ মার্চ সকালে বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে এনে রমনা কালী মন্দিরে ২৭ জনকে হত্যা করে পাকবাহিনী। ধারনা করা হয়, এখানে শহীদদের মধ্যে অধিকাংশই ইপিআর সদস্য।

২৭ তারিখ সকালে কয়েকঘন্টার জন্যে কারফিউ তুলে নেওয়া হয়। ঢাকার ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষ ছুটলো নিকটজনের সন্ধানে। কেউ পেলেন খুঁজে জীবিত তাদের, কেউ পেলেন স্বজনের পুড়ে যাওয়া কিংবা গুলিতে নিহত কুকুর-কাকে খাওয়া মরদেহ। পথে পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে মানুষের মরদেহ। রাজারবাগ পুলিশ লাইন বিধ্বস্ত, পুলিশ ব্যারাক-বাজার-বস্তি থেকে তখনও ধোঁয়া বেরুচ্ছে। হাসপাতালে তিল ধারণের জায়গা নেই চিকিৎসক, নার্স, আহত আর স্বজনের ভীড়ে।

অসংখ্য মানুষকে হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই পোঁটলা বেঁধে রিকশায় বা পায়ে হেঁটে ঢাকা শহর ছেড়ে যেতে দেখা যায়।

কারফিউ শিথিল করার প্রথম সুযোগেই লালমাটিয়ার গোপন ডেরা থেকে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ কেরানীগঞ্জের দিক দিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন।

এদিন নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, হিন্দুস্তান টাইমস-সহ বিশ্বের প্রধান খবরের কাগজে প্রথম পাতার উপরের অংশে স্থান পায় বাংলাদেশের খবর। মুখ্যত বলা হয়, ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর তৎপরতার কারণে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের আশা শেষ হয়ে যায়, শেখ মুজিব বাংলাদেশ নামে পাকিস্তানের পূর্বাংশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে।

২৬ মার্চ আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম জেলা সাধারণ সম্পাদক এম.এ.হান্নান দুপুর ২টা ১০ মিনিটে এবং ২টা ৩০ মিনিটে আগ্রাবাদ চট্টগ্রাম বেতার থেকে মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এদিন সন্ধ্যায় আগ্রাবাদ বেতার ভবনের নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে কয়েকজন বেতারকর্মী চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার ট্রান্সমিশন কেন্দ্রের স্টুডিও ব্যবহার করে স্বাধীন বাংলার বেতার কার্যক্রম শুরু করেন, নাম দেন “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র”। এখান থেকেই ২৬ মার্চ কিছুক্ষণ পরপর শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন এম এ হান্নান, সুলতানুল আলম, বেলাল মোহাম্মদ, আবদুল্লাহ আল-ফারুক, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, কবি আবদুস সালাম এবং মাহমুদ হাসান প্রমূখ। 

২৭ মার্চ ১৯৭১ কালুরঘাটে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে সকালে আরেকটি অধিবেশন প্রচার করা হয়। আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম জেলা সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান দুপুর ২টা ১০ মিনিটে এবং ২টা ৩০ মিনিটে আগ্রাবাদ চট্টগ্রাম বেতার থেকে মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। দুপুরে পটিয়া থেকে ফিরিয়ে আনা অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমানকে সন্ধ্যায় উপস্থিত রেডিওকর্মীরা অনুরোধ করলে তিনি ইংরেজিতে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। উল্লেখ্য, এই ঘোষণার আগে মেজর জিয়াকে কেউ চিনতো না। ঘোষণাটি হলো:

“I, Major Ziaur Rahman, on behalf of our great national leader, the supreme commander of Bangladesh Sheikh Mujibur Rahman do hereby proclaim the independence of Bangladesh. It is further proclaimed that Sheikh Mujibur Rahman is the solo leader of the elected representatives of 75 million people of Bangladesh. I therefore appeal on behalf of our great leader Sheikh Mujibur Rahman to the government of all the democratic countries of the world specially the big world part and neighboring countries to take effective steps to stop immediately the awful genocide that has been carried on by the army of occupation from Pakistan. The legally elected representatives of the majority of the people as repressionist. It is cruel joke and contradiction in terms which should be fool none. The guiding principle of a new step will be first neutrality, second peace and third friendship to all and animity to none. May Allah help us. Joy Bangla.”

‘আমাদের মহান জাতীয় নেতা এবং বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবুর রহমান-এর পক্ষে আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আমি আরও ঘোষণা করছি যে, শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের সাড়ে সাত কোটি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একমাত্র নেতা। আমি তাই আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান-এর পক্ষ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশ বিশেষভাবে পরাশক্তিসমূহের কাছে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী পরিচালিত গণহত্যা বন্ধ করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী দ্বারা আইনসম্মতভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দেওয়া একটি নির্মম কৌতুক এবং এমন এক স্ববিরোধিতা যা কারও দৃষ্টি এড়াতে পারে না। আমাদের নতুন রাষ্ট্রের অনুসৃত নীতিমালা হচ্ছে - প্রথমত নিরপেক্ষতা, দ্বিতীয়ত শান্তি এবং তৃতীয়ত সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। জয় বাংলা।’

এদিন সন্ধ্যার অধিবেশনের পর গভীর রাতে মেজর জিয়া আবার ট্রান্সমিশন চালু করার নির্দেশ দেন এবং আবারও বেতার ভাষণ দেন তবে এবারে তিনি নিজেকে “I, Major Ziaur Rahman, as head of provisional government of Bangladesh…” উল্লেখ করেন যা উপস্থিত বেতারকর্মী এবং চট্টগ্রামের নেতৃস্থানীয়দের মাঝে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়।

এদিন গভীররাতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থানরত বিদেশি সাংবাদিকদের জোর করে বিমানবন্দরে এনে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের (পিআইএ) একটি প্লেনে উঠিয়ে ঢাকা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।

দুপুরে কারফিউ পুনরায় বলবৎ হওয়ার পর সন্ধ্যা থেকে আবারও ঢাকা শহর ও শহরতলীর বিভিন্ন এলাকায় গুলি আওয়াজ শোনা যেতে থাকে।

২৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে পূর্ণ সমর্থন দেন। শরণার্থীদের আশ্রয়ের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়া হয়। পশ্চিমবাংলা, বিহার, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা সীমান্তে শরণার্থী শিবির খোলা হয়। নির্বাসিত বাংলাদেশি সেনা কর্মকর্তা ও স্বেচ্ছাসেবীরা ওইসব ক্যাম্প থেকে মুক্তিবাহিনীর সদস্য সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ কাজে নিয়োজিত হয়।

[তথ্যসুত্র: বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ, মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর]

এডিবি/