টাঙ্গাইলে মাছের খোসা বা আশঁ রপ্তানি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। মৎস্যজীবীদের কাছে মাছের আঁশের ব্যবসা দিন দিন বাড়ছে। জেলায় মাছের বড় বাজারগুলোসহ প্রায় সব বাজারেই বটি ওয়ালারা পাইকারদের কাছে ৮০- ১০০ টাকা কেজি দরে মাছের আঁশ বিক্রি করছেন। শুধু টাঙ্গাইল নয় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিবছর বিশাল পরিমাণ মাছের আঁশ রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এই আঁশ বিক্রি করে বছরে বাড়তি আয় করছেন মৎস্যজীবীরা। শুধু বাজার নয়, অনেকেই বাসা বাড়ি থেকেও মাছের আঁশ বিক্রি করছেন।
বিভিন্ন দেশে এ আঁশ নানা দরকারি ও বিলাস পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মাছের আঁশের ব্যবসার পরিধি ব্যাপক হারে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে টাঙ্গাইলে। মাছের আঁশ বলতে সাধারণত মাছের উচ্ছিষ্ট অংশকে বুঝায় যা সচরাচর সবাই ফেলে দেয়। কিন্তু এই মাছের আঁশের নানাবিধ আশ্চর্য করা ব্যবহার রয়েছে। এক-দুই হাত ঘুরে প্রক্রিয়াজাতকরণের পর এগুলো এখন বাংলাদেশ থেকেই প্রতি বছর হাজার হাজার টন আঁশ রপ্তানি হয় জাপান, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে।
মাছের আশঁ বিশ্বব্যাপি নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে। মাছের আশেঁ থাকে কোলাজেন যা খাদ্য, ঔষধ, ফুড সাপ্লিমেন্ট ও কসমেটিকস শিল্পে ব্যবহার হয়। কোলাজেন নামক একটি পণ্য বিক্রি হয় ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। চীন ও জাপানে এই আঁশ ব্যবহার করে ইরড়-ঢ়রবুড়বষবপঃৎরপ হধহড়মবহবৎধঃড়ৎ তৈরি করা হয় যেগুলো দ্বারা রিচার্জেবল ব্যাটারিতে চার্জ দেওয়া যায়। তাছাড়া ঘরোয়া বিদ্যুৎ উৎপাদনেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে এই ইরড়-ঢ়রবুড়বষবপঃৎরপ হধহড়মবহবৎধঃড়ৎ।
এছাড়াও মাছের খোসা ব্যাটারি তৈরি, বৈদ্যুতিক পণ্য, কৃত্রিম কর্ণিয়া, মাছ ও পোল্ট্রি খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়। একটা মাছের ওজনের ২ ভাগ পরিমাণ আশঁ থাকে। কার্প জাতীয় মাছে মুলত এ আশঁ থাকে। এক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে বাৎসরিক প্রায় ২৭ হাজার ২৭৮ মেট্রিক টন মাছের আশঁ উৎপন্ন হয়। মাছ যারা কাটে, পাইকার ও ডিলাররা এসব আশঁ সংগ্রহ করে এবং সংগ্রহীত খোসার ৯০ ভাগই রপ্তানি হয় যা প্রায় ২৫০০ মেট্রিক টন। মুলত জাপান, হংকং, সিঙ্গাপুর, মালায়শিয়া, থাইল্যান্ড ও চায়নাতে এসব খোসা রপ্তানি হয়। প্রতি মেট্রিকটন খোসা ৩৫০-৪৭০ ডলারে বিক্রি হয়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সমিক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশ বছরে ২০০ কোটি টাকার মাছে খোসা রপ্তানি করে। এই পেশার সাথে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ সরাসরি জড়িত। ১০-১২ টি দেশি বিদেশী ট্রেডার এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে।
গবেষকরা মনে করছেন, মাছের আঁশ সবার কাছে উচ্ছিষ্ট হলেও এর অর্থনৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে দেশে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ মাছের আঁশ বিদেশে রপ্তানি করা হয় কিন্তু দেশে এর বাণিজ্যিক ব্যবহার এখনো বৃহদাকারে প্রচলিত হয়নি। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে মাছের আঁশের বাণিজ্যিক ব্যবহার নিশ্চিত করা ও যথাযথ মূল্যে এর রপ্তানির উদ্যোগ নেয়া এখন সময়ের দাবি। এছাড়াও মানুষের পুড়ে যাওয়া ক্ষতের চিকিৎসা, প্রসাধনী তৈরি, কোলাজেন পাউডার তৈরি, আঠা তৈরি, পোশাক তৈরি, সাজসজ্জার সরঞ্জাম তৈরি, প্রাণিখাদ্যের উপাদান হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবহার করা হয় মাছের আঁশ ও এর থেকে উদ্ধৃত উপাদান। এছাড়াও ভারী ধাতুর দূষণ নিরসন করতে ও পানি বিশুদ্ধকরণের উপাদান হিসেবেও মাছের আঁশ ভূমিকা রাখে।
মৎস্যজীবীরা জানিয়েছেন, মাছের আঁশ সংগ্রহ করার পর সেই আঁশগুলো পরিষ্কার পানিতে অথবা গরম পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। তারপর রোদে শুকানোর পর ঝরঝরে করা হয়। এরপরই বিক্রির উপযোগী হয়। বছরে দুই থেকে তিন বার এই আশঁ বিক্রি করা হয় পাইকারদের কাছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকার এসে মাছের আশঁ গুলো কিনে নিয়ে যায়। প্রতি মণ আশঁ বিক্রি করা হয় ৩৬০০ থেকে ৪০০০ হাজার টাকা করে। শুধু আঁশ নয় মাছের নাড়িভুঁড়িও বিক্রি হয়। নাড়িভুঁড়ি ব্যবহার করা হয় মাছের খাদ্য হিসেবে। মাছের জাত অনুযায়ী আঁশের দাম ভিন্ন হয়। রুই,কাতলাসহ বিভিন্ন বড় মাছের আঁশের দাম একটু বেশি। আর ছোট মাছের আশেঁর দাম আরেক রকম। শহরের বড় দুই বাজার পার্ক বাজার এবং ছয়আনি বাজার থেকে প্রায় ১৫-২০ জন মাছ কাটার পাশাপাশি মাছের আশঁ বিক্রি করছেন নিয়মিত।
টাঙ্গাইল ছয়আনি মাছের বাজারে নিয়মিত মাছ কাটেন (বটি ওয়ালা) সজীব। মাছ কাটতে প্রতি কেজিতে তিনি নেন ২০-৩০ টাকা করে। মাছ কাটেন দুপুর ১টা পর্যন্ত। মাছের আশঁ বিক্রি করে বছরে বাড়তি আয় করছেন বছরে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। প্রতিবছর ৬-৮ মণ মাছের আশঁ বিক্রি করছেন পাইকারদের কাছে।
আরেক বটি ওয়ালা মো. সোহেল বলেন, আমি প্রায় ১৪ বছর ধরে মাছের ব্যবসা করি। আর মাছের আশঁ বিক্রি করি প্রায় ৭ বছর যাবত। বছরে দুই তিনবার মাছের আশঁ বেচা যায়। চট্রগ্রাম,বগুড়া ও ঢাকা থেকে কয়েকজন পাইকার আসে টাঙ্গাইলে আশঁ কিনতে। মাসখানে আগে ৪ মণ মাছে আশঁ বিক্রি করেছি ৩৬০০ টাকা মণ করে। দাম এখন কিছুটা কম যাচ্ছে। তারপরও ভাল বছরে বাড়তি আয় হচ্ছে।
বগুড়ার মাছের আঁশের পাইকার মো.মনির বলেন, আমি ঢাকায় এক লোকের কাছে বছরে ৪০ টন মাছের আঁশ বিক্রি করি। টাঙ্গাইলে প্রায় দুই বছর ধরে মাছের আঁশের ব্যবসা শুরু করি। এই টাঙ্গাইল থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন সময়ে ৩-৪ টন মাছের আঁশ কিনে থাকি। বাজার যখন ভাল থাকে তখন সর্বচ্চো ১০০ টাকা কেজি দরে এখন বাজার দর একটু কম প্রতি কেজি ৯০ টাকা করে আশঁ কিনছি।
তিনি আরও বলেন, রাজশাহী,কুষ্টিয়া,পাবনাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মাছের আঁশ সংগ্রহ করে ঢাকায় বিক্রি করি। মাছের আঁশের চাহিদা রয়েছে প্রচুর। এই আশঁ দিয়ে শুনেছি অনেক কিছুই তৈরি করা হয়। ঔষধ,লিপস্টিক,নেইল পলিশসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করে থাকে।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির, নিউট্রিশন এ্যান্ড ফুড ইন্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের সহকারী অধ্যাপক মোঃ হারুন-অর রশীদ, যিনি মাছের খোসা থেকে বিভিন্ন খাদ্য উপাদান তৈরির প্রযুক্তি উদ্বাবন নিয়ে পিএইচডির গবেষণা করছেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে মাছের খোসা থেকে বিভিন্ন উপাদান তৈরির সুযোগ রয়েছে যার মাধ্যমে পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব না ফেলেও অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হওয়া যাবে। কিন্তু এর মুল অন্তরায় হচ্ছে প্রযুক্তির অপ্রতুলতা বা প্রযুক্তি উদ্বাবনের গবেষণার অভাব, বাজারে প্রতিযোগিতা মুলক অবস্থান সৃষ্টির জন্য সহযোগিতার অভাব সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এ সেক্টরে বিনিয়োগের সংস্কৃতি তৈরি না হওয়া।
টাঙ্গাইল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন মাছের আঁশ নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে। জিন্টপ্যান্ট, গ্যাভার্ডিন কাপড়ের উপর এক ধরণের আঠার প্রলেপ দেওয়া হয়,যার ফলে কাপড়ের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়। ক্যাপসুলের খোসা ও প্রসাধনী সামগ্রী তৈরিতেও মাছের আঁশ ব্যবহার করা হয়। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আশঁ নিয়ে বিভিন্ন সময় গবেষণা করে সফল হয়েছে। মাছের আঁশ এখন বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, টাঙ্গাইল জেলায় সব মাছ বাজারে গুলো নিয়ে কাজ শুরু করা হয়েছে, প্রতিদিন কি পরিমাণ মাছের আঁশ সংগ্রহ করা হয় তার একটা জরিপের কাজ চলছে। কাজ শেষ হলে আরও বিস্তারিত বলা যাবে।