ন্যাভিগেশন মেনু

ভাসানচরে গেলেই রোহিঙ্গারা উন্নত জীবনমান পাবে


সেনা অভিযানের মুখে মায়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে কক্সবাজার জেলায় আশ্রয় নিয়েছেন ১১ লাখ রোহিঙ্গা। জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জীবনমান বদলে দেয়ার সব আয়োজন রয়েছে ভাসানচরে। রাষ্ট্রসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) স্ট্যান্ডার্ড মেনে সেখানে তৈরি করা হয়েছে পরিকল্পিত আবাসন। 

রোহিঙ্গাদের জন্য সেখানে এমন সব সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে, যা দেশের নাগরিকদের বড় একটি অংশ এখনও পায় না। ইতিমধ্যে ২২টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) সেখানে কাজ শুরু করেছেন। এর আগে পরিদর্শনে গেলেও এবার চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহে প্রস্তুত তারা। 

সেখানে পরিকল্পিত আবাসন, ভাসানচরের পরিবেশ ও সার্বিক ব্যবস্থাপনা দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন এনজিওকর্মীরা। উন্নত জীবনমান নিশ্চিতে রোহিঙ্গাদের কক্সবাজারের ঘিঞ্জি শরণার্থীশিবিরগুলো থেকে ভাসানচরে স্থানান্তরের পরামর্শও তাদের। এদিকে স্বেচ্ছায় যেতে ইচ্ছুক আড়াই হাজার রোহিঙ্গাকে ডিসেম্বরের শুরুর দিকেই ভাসানচরে স্থানান্তরের কাজ শুরুর কথা রয়েছে। 

ভাসানচরে গিয়ে দেখা গিয়েছে, রোহিঙ্গাদের মানসম্মত জীবন নিশ্চিতে সব ধরনের আয়োজন রয়েছে সেখানে। ৪টি উন্নত ওয়্যারহাউসে খাবার মজুদ চলছে। এখানে মজুদ করা খাবার দিয়ে ১ লাখ মানুষের ৩ মাসের খাবার নিশ্চিত করা যাবে। ইতিমধ্যেই ভাসানচরে ১০০ টনের উপরে খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছেছে। 

আরও কয়েকশ’ টন সামগ্রী পাঠানোর প্রস্তুতি আছে। ৭০ জনেরও অধিক এনজিওকর্মী রোহিঙ্গাদের সেবা নিশ্চিতে দিন-রাত কাজ করছেন। আছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের ২০ জন প্রতিনিধি। নিরাপত্তা নিশ্চিতে নিয়োজিত আছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। 

আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) ও নোয়াখালী জেলা পুলিশের তিন শতাধিক সদস্য ভাসানচরে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন নোয়াখালীর পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন। ভাসানচর আবাসন প্রকল্পের পরিচালক নৌবাহিনীর কমডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী বলেন, আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে পরিকল্পিতভাবে এ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। 

অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে নির্মাণ কাঠামো করা হয়েছে। মানসম্মত জীবনধারণের সব আয়োজন রয়েছে এখানে। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ অবস্থান নিশ্চিতে সব ধরনের ত্রুটি এড়িয়ে কাজটি করার চেষ্টা করেছি। আশা করছি, শিগগিরই তারা এখানে আসবে। 

ভাসানচরে কাজ শুরু করা ২২টি এনজিও হল: পালস বাংলাদেশ সোসাইটি, কুয়েত সোসাইটি ফর রিলিফ (কেএসআর), ফ্রেন্ডশিপ, সোশ্যাল এজেন্সি ফর ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড অ্যাডভান্সমেন্ট ইন বাংলাদেশ (এসএডব্লিউবি), শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, গ্লোবাল উন্নয়ন সেবা সংস্থা, আল-মানহিল ওয়েলফেয়ার, সনি ইন্টারন্যাশনাল, আলহাজ শামসুল হক ফাউন্ডেশন, হেল্প দ্য নিডি চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, জনসেবা কেন্দ্র, ক্যারিটাস বাংলাদেশ, সমাজকল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা (স্কাস), সোশ্যাল এইড, সিডিডি, মুক্তি কক্সবাজার, ভলান্টারি অর্গানাইজেশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট, আরটিএম ইন্টারন্যাশনাল, মাল্টি সার্ভ ইন্টারন্যাশনাল (এমএসআই), আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং হেলথ অ্যান্ড এডুকেশন ফর অল (এইচএইএফএ)।

এনজিও প্রতিনিধিসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ভাসানচরে স্থানান্তর করা হলে জীবন সম্পর্কে ধারণাই পাল্টে যাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর। উন্নত আবাসন, অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ, উন্নত ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ, পর্যাপ্ত সুপেয় পানি, পরিবেশসম্মত সেনিটেশন সুবিধা, জীবিকানির্বাহের সুযোগ, খাদ্য সংরক্ষণ ও সরবরাহ ব্যবস্থা তাদের জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করবে। 

এর পাশাপাশি নিরবচ্ছিন বিদ্যুৎ সরবরাহ, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা তাদের জীবনকে সহজ করবে, চিন্তার জগৎকে সম্প্রসারিত করবে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কক্সবাজারের প্রকল্প পরিচালক জনাব আলী বলেন, কক্সবাজার থেকে সবদিক দিয়েই রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচর ভালো হবে। বিশেষ করে কক্সবাজারে থাকাটাই তাদের জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্টের। 

কক্সবাজারে ২০ জনের জন্য ১টি টয়লেট এবং ৮০ জনের জন্য ১ স্নানঘর আছে। কিন্তু ভাসানচরে ১১ জনের জন্য একটি টয়লেট ও ১৬ জনের জন্য ১টি স্নান ঘর রয়েছে। সার্বক্ষণিক জল ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে ৫-১০ হাজার রোহিঙ্গার কথা মাথায় রেখে আমরা পাঁচটি সংগঠন মিলে তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে একটি টিম করেছি। এখানে ডাক্তার, নার্সসহ ২২ জন রয়েছেন। প্রয়োজনে এই সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। 

রোহিঙ্গাদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করছে মাল্টি সার্ভ ইন্টারন্যাশনাল (এমএসআই)। সংস্থাটির নির্বাহী প্রধান মো. জুবায়ের বলেন, কক্সবাজার আর ভাসানচরে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। থাকা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎসহ সব মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা রয়েছে ভাসানচরে। 

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। ছোট একটি ত্রিপলের নিচে ক্লাস নেয়া হয়। পরিবেশগত কারণেও সেখানে যথাযথ শিক্ষা দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এখানে যেভাবে স্কুলগুলো করা হয়েছে, তা গ্রামে তো দূরে থাক, অনেক শহরেও নেই। 

পাহাড়ের কারণে কক্সবাজোরে ভূমিধসের ভয় আছে। কিন্তু ভাসানচরে সমান্তরাল জায়গা। বসবাসও নিরাপদ। ঘরগুলো স্ট্যান্ডার্ড ক্লাস্টার হাউস। প্রতিটি ঘরের জন্য ইউএনএইচসিআর’র স্ট্যান্ডার্ড মেনে ৩ দশমিক ৯ বর্গমিটার জায়গা রাখা হয়েছে। আমরা রোহিঙ্গাদের জন্য কম্বল, সোয়েটার, চাদরসহ বিভিন্ন পোশাকসামগ্রী নিয়ে এসেছি।

তিনি বলেন, ‘অনেকেই অভিযোগ করছেন ভাসানচর বসবাসের উপযোগী নয়। তারা এখানে এসে থাকলেই বুঝতে পারবেন বসবাস উপযোগী কি না। কারণ আমার কাছে এখানকার পরিবেশ কক্সবাজার থেকে অনেক ভালো মনে হয়েছে।’ আরটিএম ইন্টারন্যাশনালের মেডিকেল সহকারী এনাম আহমেদ বলেন, রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে ডাক্তারসহ আমাদের পুরো টিম প্রস্তুত। 

এখানে ২০ শয্যাবিশিষ্ট দুটি হাসপাতাল ও চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। স্কাস’র মনিটরিং ও রিপোর্টিং অফিসার মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, এখানকার পরিবেশ কক্সবাজার থেকে অনেক বেশি ভালো। সবকিছুই বিজ্ঞানম্মত ও পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। 

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্রিটিশ কোম্পানির ডিজাইনে শক্তিশালী বাঁধ দিয়ে দ্বীপকে সুরক্ষিত করা হয়েছে। প্রায় ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে মূলত ক্লাস্টার হাউস, শেল্টার স্টেশন বা গুচ্ছগ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এই আবাসস্থল। প্রকল্পে রয়েছে মোট ১২০টি ক্লাস্টার হাউস। পরিকল্পিত নকশায় ভূমি থেকে প্রতিটি ক্লাস্টার হাউস ৪ ফুট উঁচু করে নির্মাণ করা হয়েছে। 

প্রতিটি হাউসে ১২টি গৃহ এবং প্রতিটি গৃহে ১৬টি রুম। প্রতিটি রুমে পরিবারের ৪ জন করে থাকতে পারবে। দুর্যোগ থেকে রক্ষায় প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসের সঙ্গে রয়েছে একটি করে সাইক্লোন শেল্টার। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় প্রতিটিতে ১ হাজার করে ১২০টি সেন্টারে ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। 

এ ছাড়াও প্রতিটি সাইক্লোন শেল্টারের নিচতলায় আশ্রয় নিতে পারবে ২শ’ করে গবাদি পশু। সাইক্লোন শেল্টারগুলো এমনভাবে স্টিল, কংক্রিট এবং কম্পোজিট স্ট্র্যাকচারে তৈরি, যা ২৬০ কিলোমিটার গতির ঘূর্ণিঝড় বহন করতে সক্ষম।

এস এস