ন্যাভিগেশন মেনু

মিতু খুনে কিভাবে ধরা খেল সাবেক এসপি বাবুল


বহুল আলোচিত মিতু হত্যায় সাবেক এসপি বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা নিয়ে পিবিআই নিশ্চিত হল কী করে? এ প্রশ্ন সবার মধ্যে কৌতুহল সৃষ্টি করেছে। 

এ বিষয়ে তদন্ত করেছেন এমন একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাবুলের আর্থিক লেনদেনের তথ্য যাচাই–বাছাই করতে গিয়েই হত্যাকাণ্ডে তাঁর জড়িত থাকার বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। 

তাঁরা মূলত ২০১৬ সালে মিতু হত্যার আগে-পরে বাবুল আক্তারের আর্থিক লেনদেনের খোঁজখবর করেন। তাঁরা দেখতে পান, হত্যাকাণ্ডের তিন দিনের মাথায় বাবুল আক্তার তিন লাখ টাকা খরচ করেছেন। এই পর্বেই তাঁরা গাজী আল মামুন ও সাইফুল হককে খুঁজে পান।

তাঁরা জানতে পারেন, বাবুল আক্তারের ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল হকের কাছ থেকে লাভের তিন লাখ টাকা চেয়ে নিয়েছিলেন বাবুল। ওই টাকা তিনি নড়াইলের গাজী আল মামুনের কাছে পাঠান। 

মামুন সেই টাকা এই মামলার অন্যতম আসামি কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা ও ওয়াসিমসহ অন্যদের মধ্যে ভাগ করে দেন। পাঁচ বছর আগের ওই লেনদেনের তথ্য পিবিআই বিকাশ থেকে সংগ্রহ করে।

তদন্ত কর্মকর্তারা টুকটাক নানা বিষয়ে বাবুল আক্তারকে প্রশ্ন করেন। আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি। একেকবার একেক কথা বলেন। 

মিতু হত্যার কয়েকমাস আগে বাবুল একটি ট্রেনিংয়ে থাকা অবস্থায় গায়ত্রী তার বাসায় দুইটি বই উপহার পাঠান। বই দুটির নাম-তালিবান ও বেস্ট কেপ্ট সিক্রেট। তালিবান বইটির ৩ নম্বর পৃষ্ঠায় গায়ত্রী নিজ হাতে একটি বার্তা লিখে দেন। 

সেখানে লেখা ছিল, ‘আমাদের ভালো স্মৃতিগুলো অটুট রাখতে তোমার জন্য এই উপহার। আশা করি এই উপহার আমাদের বন্ধনকে চিরস্থায়ী করবে। ভালোবাসি তোমাকে। ’

একই বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় বাবুল একটি নোট লিখে রাখেন। নোটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর গায়ত্রীর সঙ্গে প্রথম দেখা হয় বাবুলের। একে অপরকে প্রথমবার চুমো খান ৫ অক্টোবর। 

এর দুদিন পর ৭ অক্টোবর দুজনের মধ্যে প্রথম শারীরিক সম্পর্ক হয়। দুজনে প্রথমবারের মত কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে হাঁটেন ৮ অক্টোবর। এসব তথ্যের সঙ্গের ১০ অক্টোবর গায়ত্রীর জন্মদিনের তথ্যও ওই পাতায় নোট করে রাখেন বাবুল আক্তার। 

এছাড়া বেস্ট কেপ্ট সিক্রেট নামের বইয়ের ২য় পাতায় গায়ত্রীর নিজ হাতে লিখেন ‘তোমার ভালোবাসার গায়ত্রী।

গায়ত্রীর বিষয়ে, মিতুর মা সাহেদা মোশাররফ বলেন, পুলিশের দাপট ও টাকার জোরে বিভিন্ন নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন বাবুল। এমনটি জানিয়ে মিতুর মা বলেন, ‘আমার মেয়ে একদিন রাত ৩টার সময় ফোন দিয়ে বলেছিল, মা, আমি কালই ঢাকায় চলে আসব। 

তবে বাবুলের আশা ছিল, জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ তাঁকে ছেড়ে দেবে। বিকেলের পর তিনি বুঝতে পারেন, তিনি আটকা পড়েছেন। তদন্ত কর্মকর্তারা ধীরে ধীরে বাবুলের কাছ থেকে মুঠোফোনগুলো নিয়ে নিতে শুরু করেন। 

এ সময় তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। জিজ্ঞাসাবাদে থাকা একজন বলেন, ‘বাবুল আক্তার নিজেও পুলিশ অফিসার ছিলেন। তাঁর ডিভাইসগুলো নিয়ে নেওয়ার পরই তিনি ধরা পড়ে গেছেন বলে বুঝতে পারেন।’ 

এরপর তিনি কাকুতি-মিনতিও করেন, কেউ ধরা পড়ে গেলে যেমন করে থাকেন তেমনই। সন্তানদের কথাও বলেন তিনি।

পিবিআই এর উপমহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, তাঁদের তদন্তের শুরুটা হয়েছিল একটা প্রশ্নের জবাব খোঁজার মধ্য দিয়ে। সেটা হলো ঘটনাস্থলে মুসা থাকার পরও কেন তাঁকে শনাক্ত করতে পারলেন না বাবুল আক্তার। 

তিনি আরও বলেন, বাবুল আক্তার একজন চৌকস কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি মুসাকে দায়ী না করে জঙ্গিদের ওপর দায় চাপান এবং জানান মিতু হত্যাকাণ্ডের দিন কয়েক আগে জঙ্গিরা তাঁর ওপর হামলা করেছিল। 

এজাহারে মোশাররফ হোসেন লেখেন, জাতিসংঘে কর্মরত একজন নারীর সঙ্গে পরকীয়ার কারণে তাঁর মেয়ের সঙ্গে জামাইয়ের দাম্পত্য কলহ চরমে পৌঁছেছিল। 

মোশাররফ লেখেন, ‘হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দানকারী ২ নং বিবাদী মো. কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুসা  বাবুল আক্তারের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত ও পারিবারিকভাবে পরিচিত সোর্স হওয়া সত্ত্বেও সুকৌশলে তাঁকে শনাক্ত না করে জঙ্গিদের দ্বারা হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে মর্মে দাবি করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা করে।’

মোশাররফ আরও লেখেন, বাবুল আক্তার পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়লে পরিবারে চরম অশান্তি দেখা দেয়। এ নিয়ে প্রতিবাদ করায় মিতুকে বাবুল আক্তার বিভিন্ন সময় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন। 

মিতুর বাবা এজাহারে ওই নারীর সঙ্গে বাবুল আক্তারের বিনিময় কিছু খুদে বার্তার উল্লেখ করেন।এই মুহূর্তে এই মামলায় বাবুলসহ আট আসামির দুইজন কারাগারে আছেন। 

বুধবার রাতেই মামলার আরেক আসামি সাইদুল ইসলাম শিকদার ওরফে সাকুকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব । সাকুর ভাই কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুসা এই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সন্দেহভাজন। পুলিশের ভাষায় তিনিসহ আরেক আসামি পলাতক আছে। 

বাকি দুই আসামি আগের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিনে আছেন। পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম জেলা ও মেট্রো ছাড়াও এই মামলার তদন্তে একযোগে কাজ করে ঢাকার চারটি, গোপালগঞ্জ ও খুলনার দুটি ইউনিট। 

তারা একইসঙ্গে তিনজনকে নজরদারির আওতায় আনে। সব তথ্য যাচাইবাছাইয়ের পর গত বুধবার পিবিআই বাবুল আক্তারকে ডেকে পাঠায়। বাবুল এক দিন সময় চান। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার বলতে পারবেন কবে তিনি দেখা করতে পারবেন। সোমবার তাঁকে চট্টগ্রামের পিবিআই কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। একই সময়ে বাবুল আক্তারের পরিচিত দুই ব্যক্তিকেও জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। তবে তাঁদের মুখোমুখি করা হয়নি। এর প্রয়োজনও ছিল না বলে মন্তব্য করেন তাঁরা।

তখন আমি মিতুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কী হয়েছে? মিতু তখন বলেছিল, কক্সবাজারের একটি হোটেলে একজন নারীর সঙ্গে বাবুলকে দেখেছে মিতু। বহুবার আমার মেয়ে আমাকে বলেছিল। শুধু দুই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে বাবুলের সঙ্গে সংসার করেছে। 

কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেয়ে আর বাঁচতে পারল না। ওরা আমার নাতির সামনে আমার মেয়েকে খুন করে ফেলল।

২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। ওই সময় এ ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়। 

ঘটনার সময় মিতুর স্বামী পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার অবস্থান করছিলেন ঢাকায়। ঘটনার পর চট্টগ্রামে ফিরে তৎকালীন পুলিশ সুপার ও মিতুর স্বামী বাবুল আক্তার পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের জন্য স্ত্রীকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে মামলায় অভিযোগ করেন তিনি। তবে দিন যত গড়িয়েছে মামলার গতিপথও পাল্টেছে। এক পর্যায়ে সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে আসে স্বামী বাবুল আক্তারের নাম।

এস এস