ন্যাভিগেশন মেনু

মোদী বিরোধীতার নামে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ফাটল ধরানোর অপচেষ্টা


তাপস হালদার

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত সরকার,ভারতীয় মিত্র বাহিনী, সর্বোপরি  ভারতীয় জনগনের যে অবদান রেখেছে তা বাংলাদেশ কৃতজ্ঞচিত্তে চিরদিন স্মরণ করবে। ভারত ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষকে আশ্রয় ও আহার দিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ও অস্ত্র দিয়েছিল। ভারতীয় সৈন্যরা  মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে বাংলাদেশের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। শুধুমাত্র যুদ্ধে সহযোগিতা করেই দায়িত্ব শেষ করে নি। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুর্নগঠনে নগদ অর্থ ও খাদ্য সহায়তা দিয়েও পাশে দাঁড়িয়েছিল।সেই বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী  উপলক্ষ্যে  ভারতের প্রধানমন্ত্রী অতিথি থাকবেন,সেটাই তো স্বাভাবিক। এখানে নরেন্দ্র মোদী তো কোন ব্যক্তি নয়,তিনি ১৩০ কোটি ভারত বাসীর প্রতিনিধি। তাঁর মাধ্যমেই গোটা ভারত বাসীকে সম্মান জানানো হবে। আরো একটি কারণে এ সফরটি গুরুত্বপূর্ণ। এবছরটি বাংলাদেশ – ভারত কুটনৈতিক সম্পর্কেরও সুবর্ণজয়ন্তী।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষ্যে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ‘মুজিব চিরন্তন’ প্রতিপাদ্য নিয়ে  ১৭ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত  ১০ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে।

প্রতিদিন পৃথক থিমভিত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠান,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,অডিও ভিজ্যুয়াল এবং অন্যান্য বিশেষ পরিবেশনার মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হচ্ছে। এবং প্রতিদিন সশরীরে কিংবা ভিডিও বার্তার মাধ্যমে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখছেন। ১৭ ই মার্চ  ‘ভেঙেছে দুয়ার এসেছো জ্যোতির্ময়’ সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ, ১৮ মার্চ ‘মহাকালের তর্জনী’,১৯ মার্চ ‘যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা যমুনা’ সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে,২০ মার্চ  ‘তারুণ্যের আলোক শিখা',২১ মার্চ ‘ধ্বংসস্তূপে জীবনের গান’,২২ মার্চ ‘বাংলার মাটি আমার মাটি’ সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভান্ডারী, ২৩ মার্চ ‘নারীমুক্তি,সাম্য ও স্বাধীনতা’,২৪ মার্চ ‘শান্তি-মুক্তি ও মানবতার অগ্রদূত’, সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ডা.লোটে শেরিং,২৫ মার্চ ‘গণহত্যার কালরাত্রি ও আলোকের অভিযাত্রা’, এবং ২৬ শে মার্চ সমাপনী দিনে  ‘স্বাধীনতার পঞ্চাশ  বছর ও অগ্রগতির সুবর্ণরেখা’ সম্মানিত অতিথি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী। এছাড়াও ভিডিও বার্তায় শুভেচ্ছা জানিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইউশিহিদে সুগা,কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ভি লাভরফ,কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন,ওআইসির মহাসচিব ড.ইউসেফ আহমেদ আল-ওথাইমিন,ইউনেস্কোর মহাসচিব ইরিনা বোকাভা,পোপ ফ্রান্সিস, দক্ষিন কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী চুং স্যু-কুয়েন,  সহ বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দুই দিনের সফরে একগুচ্ছ কর্মসূচী আছে। সফর সূচীর মধ্যে রয়েছে ২৬ মার্চ ঢাকায় পৌছেই সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে  মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, ধানমন্ডিতে জাতীয় পিতার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ ও বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শণ,বিকেলে প্যারেড গ্রাউন্ডে সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য প্রদান,,সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সন্মেলন কেন্দ্রে  বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে ‘বঙ্গবন্ধু-বাপু' ডিজিটাল প্রদর্শনী পরিদর্শন,সফরের দ্বিতীয় দিন(২৭ মার্চ) টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ পরিদর্শন ও শ্রদ্ধা নিবেদন,গোপালগঞ্জ ও সাতক্ষীরায় দুইটি মন্দির পরিদর্শন,বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব সম্পর্কের  ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিট উন্মোচন এবং মেহেরপুরে স্বাধীনতা সড়ক ভার্চ্যুয়ালি উদ্ভোধন। এছাড়া কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরকে কেন্দ্র করে কিছু চিহ্নিত মৌলবাদী,তথাকথিত বাম সংগঠন ও স্বঘোষিত সু-শীল নামধারী বিএনপি জামায়াতের এজেন্টরা বিরোধীতা ও প্রতিহত  করার আন্দোলনে নেমেছে। এদের পিছনে যে বিএনপি,জামায়াতের ইন্ধন ও অর্থায়ন আছে সেটা তো দিবালোকের মত স্পষ্ট। এই বিরোধীতাকারিরা কারা?এদেরকে বাংলার জনগন চিনে। এদের মুরব্বিরা বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকে বলেছিল ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ। এরা বাংলাদেশের অস্তিত্বকে কখনো স্বীকার করে না। এরা ২১ ফেব্রুয়ারী, ৭ মার্চ,২৬ মার্চ,১৬ ডিসেম্বর মানেনা,আবার এদেরই অনেকে লোক দেখানো মানলেও হৃদয়ে ধারণ করে না। এরা বাংলাদেশ,বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করে। এরা ভাস্কর্য বিরোধীতার নামে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বঙ্গবন্ধুকে বুড়িগঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলার হুমকি দেয়। এরা কথায় কথায় দেশরত্ন শেখ হাসিনা ও বর্তমান সরকারের চৌদ্দ গোষ্টী উদ্ধার করে। যারা ভারতের বিরোধীতা করে রাজনীতির মাঠ গরম করে ফায়দা লুটে,তারাই তো নরেন্দ্র মোদীর সফরের  বিরোধীতা করবে সেটাই তো স্বাভাবিক।

এত বরেণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে নরেন্দ্র থেকে কেন মোদীকে টার্গেট করা হলো?সেটা তো ওদের পেয়ারে পাকিস্তান,সে জন্যই।ধর্মের জুজু তুলে বলা হচ্ছে যে,মোদী  ইসলামের শত্রু। তিনি যদি প্রকৃতই ইসলামের শত্রুই হতেন তাহলে কি মুসলিম প্রধান দেশগুলো তাঁকে কখনো সম্মানিত করতেন?এ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদীকে বাহরাইন থেকে ‘কিং হামাদ অর্ডার অব রেনেশাঁ',সংযুক্ত আরব থেকে ‘অর্ডার অব জায়েদ’,ফিলিস্তান থেকে ‘গ্র্যান্ড কলার অব স্টেট অব প্যালেস্টাইন',আফগানিস্তান থেকে ‘ আমির আমানুল্লা খান পুরস্কার’,সৌদি আরবের ‘কিং আবদুল্লাজিজ সাশ পুরস্কার',এবং মালদ্বীপের ‘রুল অব নিশান ইজ্জুদ্দিন পুরস্কার’সহ  মর্যাদাপূর্ণ সম্মাননা দিয়েছেন।তাহলে এই বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্য ভিন্ন সেটা দিবালোকের মতই স্পষ্ট।

বিএনপি মহাসচিব সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বরাবরের মতই নতুন তত্ত্ব হাজির করেছে,পশ্চিম বঙ্গের নির্বাচনের জন্যই নাকি মোদীর এই সফর। এটা যে কত বড় মিথ্যাচার তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কারণ গত বছরের এই অনুষ্ঠানেই ভারতের প্রধানমন্তী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরে আসার কথা ছিল কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে অনুষ্ঠান স্থগিত হওয়ায় সফরও স্থগিত হয়েছিল। তখন তো কোন নির্বাচন ছিল না। গণমাধ্যমে তো সংবাদ এসেছে, মোদীর সাথে সাক্ষাতের জন্য বিএনপি মরিয়া চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সাক্ষাতের সুযোগ না পাওয়ায় এখন এই সব উল্টা পাল্টা মন্তব্য করছে। ২০১৪ সালে ভারতে যখন নরেন্দ্র মোদী প্রথম ক্ষমতায় এসেছিল তখন উল্লাস করে কারা রাস্তায় মিষ্টি বিতরণ করেছিল,কারা অমিত শাহের নামে ভুয়া টেলিফোনের নাটক করেছিল সে কথা কিন্তু জনগন ভুলে যায়নি।যখন ভারত থেকে করোনার টিকা আনার সিন্ধান্ত হলো তখন এই বিএনপি-জামায়াতের এজেন্টরা বলতে শুরু করলো এই টিকায় সমস্যা আছে,কেউ নিবেন না।আরো কত ধরণের বাজে অপপ্রচার।আবার যখন টীকা প্রয়োগ শুরু হলো তখন সবারই আগেই লাইন ধরে টীকা নিয়ে নিলো।এসব ভন্ডদের জনগন বিশ্বাস করে না।

নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশে আসলে একটা চমক থাকে। ২০১৫ সালে যখন তিনি ঢাকা সফর করেন তখন ঘোষণা দিয়েছিলেন স্থল সীমান্ত বিরোধ নিস্পতির,এবং সেটি দ্রুত কার্যকরের ফলে ৬৮ বছরের ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে কোন যুদ্ধ ছাড়া এমন ভাবে কখনো সীমান্ত বিরোধ নিস্পতি হয়নি।এবারের সফরের ঠিক আগ মুহুর্তে ২০২০ সালের গান্ধী পুরস্কারের  জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষনা করে  পুরো বাংলাদেশের মানুষেরই মন জয় করে ফেললেন নরেন্দ্র মোদী। গান্ধী পুরস্কারের জন্য বিচারক মন্ডলীর প্রধান হলেন নরেন্দ্র মোদী নিজেই। তিনিই এই ঐতিহাসিক মুহুর্তে বাংলাদেশের জাতির পিতার প্রতি ভারতের এই সম্মান প্রদর্শনের ঘোষণা দেন। এ ঘোষণা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরর জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উদযাপন কালে এ সম্মান নিঃসন্দেহে আরো আনন্দ বয়ে আনবে। এছাড়াও বাংলাদেশকে ১০৯ টি ভেন্টিলেশন সুবিধা সম্বলিত এ্যাম্বুলেন্স উপহার দিচ্ছে ভারত। এই করোনা কালে এই ধরণের এ্যাম্বুলেন্স বাংলাদেশের জনগনের খুব উপকারে আসবে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ২০১৫ সালে ঢাকা সফর,২০১৭ ও ১০১৯ সালে দেশরত্ন শেখ হাসিনার দিল্লী সফর এবং ২০২০-২০২১ সালে দু-নেতার একাধিক ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে অনেক অমীমাংসিত বিষয় নিস্পতি হয়েছে। পারস্পারিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মাইল ফলক তৈরি হয়েছে। মোদী বিরোধীতার নামে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ফাটল রানোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে।ঠুনকো মিথ্যা ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করে যারা এই সম্পর্ককে বিনষ্ট করতে চায়,সেই চিহ্নিত ষড়যন্ত্রকারীদের অপচেষ্টা কখনো সফল হবেনা।

লেখক: সদস্য,সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

ইমেইল: haldertapas80@ gmail.com