ন্যাভিগেশন মেনু

যতটা সম্ভব নিরাপদে থাকুন, সরকার ঘোষিত নিয়মগুলো মেনে চলুন


আসমা আক্তার

ঠিক কিভাবে লেখাটা শুরু করবো বুঝতে পারছিনা। করোনা নিয়ে এর আগেও স্ট্যাটাস দিয়েছি। উদ্দেশ্য ছিলো পরিচিত সবাইকে সতর্ক করার পাশাপাশি আমরা যারা এই করোনা সংকটে স্ব্যাস্থসেবার সাথে জড়িত ছিলাম- তাদের অনুভুতি ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করা। অথচ আজ আমি নিজেই এই ভয়ংকর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত! হ্যা, আমিও কোভিড-১৯ পজেটিভ। গত ৮ তারিখ টেস্টের রেজাল্ট পেয়েছি।যদিও তার আগে থেকেই খুব অসুস্থ ছিলাম।আর এখন জ্বর, কাশি, বুকে ব্যাথা, শ্বাস কষ্ট এবং অজানা ভয় সঙ্গি করেই হাসপাতালের কেবিনে নিঃসঙ্গ সময় কাটছে আমার!

ভাবছিলাম অসুস্থতার খবর সবাইকে জানাবো কিনা! করোনা আক্রান্ত হবার পরে স্বজন কর্তৃক রোগীদের সাথে বিভিন্ন অমানবিক আচরনের ঘটনা প্রকাশিত হবার পরে এটা এখন অনেকটা নিষিদ্ধ অসুখের মতো হয়ে গেছে। অনেক রোগীর সাথে এমন আচরণও করা হচ্ছে যাতে রোগী অসুস্থতার পাশাপাশী প্রচন্ড অপরাধবোধেও ভুগছে।

আমার সৌভাগ্য আমাকে এমন পরিস্থিতিতে পরতে হয়নি। কিন্তু এই হীনমন্যতায় যাতে কোনো রোগী না ভোগে এই কারনে সবারই উচিৎ সোচ্চার হওয়া। আমি হাসপাতালে সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছি, অন্য কেউ হয়তো একান্ত প্রয়োজনে বাহিরে এসে অজান্তেই আক্রান্ত হয়েছে। মনে রাখা উচিৎ এটা একটি অসুখ, এটা কোনো অপরাধ নয়। বরং অপরাধ হলো আক্রান্ত কারো সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করা! করোনা আক্রান্ত হলে এমনিতেই প্রচন্ড শারীরিক কষ্ট হয়, তার উপরে যদি মানসিক কষ্ট যোগ হয়- তখন সেটা আর সহ্যের ভেতরে থাকেনা।

বলবোনা বলবোনা করেও অনেকেই আমার করোনা আক্রান্তের কথা জেনে গেছে। তবে আক্রান্ত হবার পরে যে নির্মম শারীরিক কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হয় তাতে কাউকে জানানোর মতো মানসিক শক্তি কিংবা ইচ্ছে কেনোটাই থাকেনা। কিন্তু আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে পরিচিত জন, শুভাকাঙ্ক্ষী, বন্ধু-বান্ধবী ও সহকর্মীরা শোনার পরে যে পরিমান ভালোবাসা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেছে তা সত্যিই আমার কাছে অকল্পনীয় ছিলো।তাদের এই ভালোবাসার ঋণ কখনোই শোধ হবেনা।আর ভালোবাসার ঋণ শোধ করার চেষ্টাও হয়তো করা উচিৎ নয়!

মৃত্যু দিয়ে পরিবেষ্টিত আমাদের এই জীবন। অথচ প্রচন্ড মোহময়। সবাই জানি যে কোনো মুহুর্তে খেলা শেষ হয়ে যেতে পারে, তবুও এই খেলা থেকে কারোই বাদ পড়তে ইচ্ছে করে না! আমিও এর ব্যতিক্রম নই। সত্যি বলছি প্রচন্ড বাঁচতে ইচ্ছে করছে। এত এত প্রিয় মানুষ, আত্মীয়স্বজন, দুটি সন্তান- ওদের ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছেনা। করোনা কতোটা ভয়ংকর আমরা সবাই জানি।এর পরিনতি অনিবার্য মৃত্যু না হলেও মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়।তাই জানিনা আমার ভাগ্যে কি লেখা আছে। হাসপাতালের এই নির্জন কেবিনে বসে দেবদাস উপন্যাসের সেই অমর বাণী বারবার মনে পরছে-

'প্রার্থনা করিও, আর যাহাই হোক, দেবদাসের মত এমন করিয়া কাহারও যেন মৃত্যু না ঘটে। মরণে ক্ষতি নাই, কিন্তু সে সময়ে যেন একটি স্নেহকরস্পর্শ তাহার ললাটে পৌঁছে- যেন একটিও করুণার্দ্র স্নেহময় মুখ দেখিতে দেখিতে এ জীবনের অন্ত হয়।মরিবার সময় যেন কাহারও একফোঁটা চোখের জল দেখিয়া সে মরিতে পারে।’ দেবদাসের মৃত্যুর পরে তবুও তার পারু তাকে দেখতে ছুটে এসেছিলো কিন্তু অভিশপ্ত করোনা প্রিয়জনকে কাছে আসার সেই সুযোগটুকুও কেড়ে নিয়েছে! উল্টো সবাইকে আলাদা থাকতে হচ্ছে; আর কারো মৃত্যু হলে সাদা প্লাস্টিক ব্যাগে মোড়ানো মরদেহ নিয়ে যাচ্ছে পিপিইতে মোড়ানো দু'চারজন মানুষ! উফ!

প্রচন্ড শারীরিক কষ্ট, দুর্বলতার পরেও কেবিনে নিজের অপরিহার্য কাজগুলো নিজেকেই করতে হয়। এটা কতটা কষ্টের সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবেনা। কিন্তু এটাই নিয়ম। কারন সবাইকেই নিরাপদে থেকে চিকিৎসা সেবা দিতে হবে। চাইলেও কেউ কারো জন্য কিছু করতে পারছেনা। তবুও আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার হাসপাতালের সকল কর্মকর্তা, চিকিৎসক, নার্স সহ সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। শ্বাস কষ্ট হলে যদি সময়মতো অক্সিজেন পাওয়া না যায় তাহলে কেমন লাগে সেটা নিশ্চয়ই বলে বোঝাতে হবেনা। তাই প্লিজ সবাই যতটা সম্ভব নিরাপদে থাকুন, সরকার ঘোষিত নিয়মগুলো মেনে চলুন। 

অসুস্থ না হলে হয়তো বুঝতেই পারতামনা মানুষ আমাকে এতটা ভালোবাসে, এমনকি আমিও বুঝতে পারতামনা তাদেরকে আমিও কতটা ভালোবাসি। পৃথিবীটা এত সুন্দর সেটাও আগে কখনো এভাবে অনুভব করিনি। মায়ের মুখ, বাবুদের মুখ প্রতিটি মুহুর্তেই মনে পরছে। কিন্তু অসহনীয় গলা ব্যাথার জন্য ফোনে কারো সাথে কথাও বলতে পারিনা ঠিকমতো।ইস্ জীবনে কতকিছু করা বা দেখা বাকি রয়ে গেছে ভাবলেই প্রচন্ড মন খারাপ হয়। সবার কাছে দোয়া চাই যাতে এই বিপদ কাটিয়ে আবার প্রিয়জনদের মাঝে ফিরে আসতে পারি। বাবুদের আবার বুকে টেনে নিতে পারি। মাকে জড়িয়ে ধরিয়ে যেনো কান্না করতে পারি!

সবাইকে প্রচন্ড ভালোবাসি। আপনারাও সবাই ভালো থাকুন।একজন করোনা রোগীর শারীরিক সব কষ্টের কথা উল্লেখ করে প্রিয়জনদের টেনশন আর বাড়াতে চাইনা। সেগুলো মিডিয়ার কল্যানে আপনারা এতদিনে নিশ্চয়ই জেনেছেনে।

তাই প্লিজ সবাই সতর্ক থাকুন। নিরাপদ থাকুন। আর সবার সাথে মানবিক আচরন করুন। শুধু এটুকু বলি- আমার সকল স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী, কলিগ, বন্ধুবান্ধবী, আমার সন্তান এবং পরিবারের সবাইকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি। এটাই আমাকে বেচেঁ থাকার প্রেরণা দিচ্ছে, মানসিক শক্তি যোগাচ্ছে। সবার উদ্দেশ্যে কবির মতো বলতে চাই- আমি তোমাদের পুরনো মফস্বল শহরের মতোই ভালোবাসি যার বাতাসে কৈশোর রঙের ঘ্রাণ লেগে থাকে। তুমি- লন্ডনে যাও, প্যারিসে যাও, নিউইয়র্কে যাও এই ঘ্রাণ পৃথিবীর আর কোথাও পাবে না!

লেখক: সিনিয়র স্টাফ নার্স,  কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল