ন্যাভিগেশন মেনু

অগ্নিঝরা মার্চের ৩১তম দিন:

লাখো বাঙ্গালির ভারতে আশ্রয়, চট্টগ্রামের প্রথম গণহত্যা


৩১ মার্চ ১৯৭১। এদিন এক লাখের বেশি মানুষ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা ও নির্যাতন থেকে বাঁচতে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন।

৩১ মার্চ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। সীমান্ত অতিক্রম করার সময় সেখানকার তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী তাদের সার্বিক সহায়তা করেন। সীমান্তের ওপারে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মহাপরিদর্শক গোলক মজুমদার তাদের গার্ড অব অনার দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিনিধির মর্যাদায় গ্রহণ করে।

বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন ও সহানুভূতি জানিয়ে ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ ভারতের পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে (লোকসভা ও রাজ্যসভা) একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। লোকসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উত্থাপিত ওই প্রস্তাবে বাংলাদেশের জনগণের ওপর নির্মম হত্যাকাণ্ড বন্ধে পাকিস্তান সরকারকে বাধ্য করতে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

‘পূর্ব বাংলা সম্পর্কিত একটি প্রস্তাব’ এ বলা হয়েছিল, ‘পূর্ব বাংলায় সাড়ে সাত কোটি মানুষের অভ্যুত্থান সফল হবে। এই পার্লামেন্ট আশা করে এবং নিশ্চয়তা দিচ্ছে যে তাদের লড়াই ও ত্যাগ ভারতের জনগণের সর্বাত্মক সহানুভূতি ও সমর্থন পাবে।’

ঢাকায় এদিনও সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত আগের দিনের মতো কারফিউ শিথিল ছিল।

ঢাকার ডেমরা আর কেরানীগঞ্জের পথে শহর ছেড়ে গ্রামে পথে মানুষের যাত্রা থামেনি। চারদিন ধরে কল্যাণপুর ব্রিজে অবাঙালিদের নৃশংস তৎপরতা কমেনি বরং বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ ধরে এনেও এখানে জবাই এবং গুলি করে হত্যা করে লাশ খালে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।

বিমান হামলার পর এদিন স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্মীরা কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবনের এক কিলোওয়াট মোবাইল ট্রান্সমিটারটি তুলে ট্রাকে করে কালুরঘাট থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নেওয়া হয়। পরে এই ট্রান্সমিটারটি সীমান্ত পার করে ভারতের আগরতলায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। সেখান থেকেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচার চলতে থাকে।

৩১ মার্চ বিকেল সাড়ে ৪টায় কুষ্টিয়ার জিলা স্কুল প্রাঙ্গণ, ওয়ারলেস কলোনি আর পুলিশ লাইনে কৃষক-পুলিশ-ইপিআরের সম্মিলিত ৫০০ যোদ্ধার দল পাকিস্তানি বাহিনীর ডেল্টা কম্পানির সৈন্যদের পাঁচটি অবস্থানে হামলা চালায়। অগ্রসরমান জনতার সমুদ্র থেকে উত্থিত ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি এবং অব্যাহত গুলিবর্ষণে ডেল্টা কম্পানির প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে।

সকাল ৭টায় চট্টগ্রামের হালিশহরের কাঁচা সড়ক জংশনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড আর্টিলারি, ট্যাংকসহ ইপিআর ব্যূহ ভেদ করে হালিশহরের দিকে অগ্রসর হয়। এ সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে ৪০ জন ইপিআর সদস্য শহীদ হন। বেলা ২টায় চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দপ্তর হালিশহরের পতন ঘটে।

এদিন হালিশহরে নাথপাড়ায় পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো হয়। সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বিহারিরা এ হত্যাকাণ্ড চালায়। তারা অল্প সময়ের মধ্যে কুড়াল, কিরিচ ও রামদা দিয়ে কুপিয়ে ৩৯ জনকে নাথপাড়াবাসীকে হত্যা করে। এটিই চট্টগ্রামের প্রথম গণহত্যা।

এদিনে আরও দুটি দৈনিক পত্রিকাসহ মোট চারটি পত্রিকা প্রকাশ পায়। একটি সরকারি প্রেস ট্রাষ্টের মালিকানাধীন দৈনিক পাকিস্তান ও অপরটি ব্যক্তিমালিকানাধীন দৈনিক পূর্বদেশ। অন্য দুটি দ্য পাকিস্তান অবজারভার এবং দ্য মর্নিং নিউজ আগে থেকেই প্রকাশিত হচ্ছিলো। প্রতিটি পত্রিকা প্রকাশিত ৪ পৃষ্ঠার কাগজে কেবলই পাকিস্তান সরকার, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া, ভুট্টো আর সেনাবাহিনীর সংবাদ প্রকাশ করে। সবকটি পত্রিকায় লেখা হয়, দেশের পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হওয়ার পথে। এর মধ্যে পূর্বদেশ লেখে, “শান্তিপ্রিয় বেসামরিক নাগরিকদের যেসব দৃস্কৃতকারী হয়রানি করছিল, তাদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।”

এদিন বিকেলে কুমিল্লা সেনানিবাসে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৭০ থেকে ৮০ জন বাঙালি সেনাসদস্যদের ওপর হামলা করে পাকিস্তানি সেনারা। বাঙালি সেনারা ছয়ঘণ্টা যুদ্ধ করে রেজিমেন্ট ইউনিট দখল করে।

[তথ্যসুত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ]

এডিবি/