ন্যাভিগেশন মেনু

শিবিরের হাতে নির্যাতিতরা স্মরণ করলেন ‘সেই’ ভয়াবহতা

‘দেরিতে হলেও ভালো সিদ্ধান্ত, এবার অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভাঙতে হবে’


একাত্তরে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত’জামায়াতে ইসলামী’র সাথে তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরকেও ‘সন্ত্রাসী সত্তা’ঘোষণা করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। শিবির নিষিদ্ধের এ ঘটনাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সংগঠনটির হাতে নির্যাতিত ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। 

শিবির প্রতিষ্ঠার গত ৪৭ বছরে সংগঠনটির হাতে নিহত হয়েছেন শতাধিক ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সাধারণ মানুষেরা। তাদের হাতে আহত হয়েছেন সশস্রাধিক মানুষ, এদের মধ্যে পঙ্গুত্বও বরণ করেছেন শতাধিক । 

তাদের দাবি, শিবিরকে আরও ১০ বছর আগে নিষিদ্ধ করলে এতো প্রাণহানি হতো না। তারপরও নিষিদ্ধ হয়েছে এটা অনেক ভালো সংবাদ।

২০১৩ সালের ১৪ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের হামলার শিকার হয়ে পঙ্গু্বে বরণ করেন। নাট্যকর্মী হাবিবুর রহমান। যিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে একাধিক নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন এবং শিবিরের রাজনীতি ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধের দাবীতে আন্দোলন করে বিতারিত করতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

তিনি বাংলাদেশ পোস্টকে বলেন, এ অপরাধে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করে মৃত ভেবে ফেলে রাখে যায়। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে বেঁচে গেলেও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। এদের নিষিদ্ধ হওয়া জরুরী ছিল। ১০ বছর আগে নিষিদ্ধ হলে তারা আজ এসব করতে পারতো না।  

ইসলামী ছাত্রশিবিরকে বিশ্বখ্যাত নিরাপত্তা বিষয়ক থিঙ্কট্যাংক প্রতিষ্ঠান আইএইচএস জেনস তাদের ২০১৩ সালের প্রতিবেদনে বিশ্বের তৃতীয় সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহিৃত করেছে। 

সম্প্রীতি কোটা সংস্কার আন্দোলন সহিংস হয়ে উঠার পিছনে ছাত্রশিবিরের সহিংসতার অভিযোগকে সামনে এনেই প্রতিষ্ঠার ৪৭ বছর পরে সংগঠনটি নিষিদ্ধ হয়েছে। 

প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছরের মাথায় ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা চট্টগ্রাম সিটি কলেজের নির্বাচিত এজিএস ছাত্রলীগ নেতা তবারক হোসেনকে কলেজ ক্যাম্পাসেই কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। কিরিচের এলোপাতাড়ি কোপে মুমূর্ষু তবারক যখন পানি পানি করে কাতরাচ্ছিল তখন এক শিবিরকর্মী তার মুখে প্রস্রাব করে দেয়।

ইসলামী ছাত্রশিবির দেশব্যাপী নৃশংসতা চালালেও তাদের হাতে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা। এরপর থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রমৈত্রী এবং জামাতের রাজনৈতিক সহযোগী বিএনপি’র ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের অসংখ্য নেতাকর্মী প্রাণ দিয়েছেন। 

ছাত্রশিবিরের হাতে নির্যাতিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা অমিত কুমার বসু বাংলাদেশ পোস্টকে বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে মুক্তচিন্তার জায়গা কিন্তু ছাত্রশিবির সবসময় মৌলবাদী চিন্তা লালন করতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বজায় রেখেছে। এখন না করে আরও ১০ বছর আগে নিষিদ্ধ করলে দেশে এতো প্রাণহানি ধ্বংস্বযজ্ঞ হতো না। চট্টগ্রামে শিবিরের হাতে ব্রাশফায়ারে এইট মার্ডার থেকে শুরু করে বহু হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের উপর হামলা করে রক্তাত করেছে, এরপরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্সেও হামলা করেছে। এদের মতো এতো নৃশংস আর কেউ নেই। 

২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল ছাত্রশিবিরের নৃশংস হামলায় ডান পা ও হাত কেটে ফেলা হয় ছাত্রলীগের নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদের, এসময় তাঁর সঙ্গে থাকা ছাত্রলীগের আরেক নেতা টগর মোহাম্মদ সালেহকে (২২) কুপিয়ে হাত-পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়েছে।

এ ঘটনায় স্মৃতিচারণ করে টগর বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের তৎকালীন সভাপতি আশরাফুজ্জামান ইমনের নেতত্বে কসাই মহিফুল, শিবলী, রমজানসহ বহিরাগত ১৫-২০ জন মিলে আক্রমণ করে মৃত ভেবে ফেলে যায়। শিবিরকে আরও আগে নিষিদ্ধ করা উচিত ছিল বলে মনে করেন সাবেক নির্যাতিত এ ছাত্রনেতা। 

শিবিরের হাতে নির্যাতিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আখেরুজ্জামান তাকিম বলেন, জামায়ত আরও ১০ বছর আগে নিষিদ্ধ হওয়া প্রয়োজন ছিল। এখন তাদের নিষিদ্ধের পরে মৌলবাদের ছায়া থেকে বের হয়ে আসতে হবে।  এখন শিবিরের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে ভাঙতে হবে। 

নিজের উপরে হামলার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আমার উপরে মাত্র ২৭ সেকেন্ড হামলা চালাতে হয়। কিন্তু আমাকে বাঁচতে ৫৬ দিন আইসিইউ’তে থাকতে হয় এবং ৯ টি অপারেশন করতে হয়েছিল। 

তার হামলার পিছনেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের তৎকালীন সভাপতি আশরাফুজ্জামান ইমন দায়ী ছিল বলে অভিযোগ করেন তিনি।


ছাত্রশিবির নিষিদ্ধের ঘটনাকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী।  ছাত্রশিবিরের হাতে এ সংগঠনের ১১ জন শহীদ -ডাঃ জামিল আকতার রতন, জুবায়ের চৌধুরী রিমু, দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য রূপম, ফারুকুজ্জামান ফারুক, বনি আমিন পান্না, শামীম আহমেদ, আতিকুল বারী, রাজু আহম্মেদ বাবলু, আইয়ুব হোসেন, মোহাম্মদ সেলিম ও আসলাম হয়েছেন।

ছাত্রমৈত্রী সাধারণ সম্পাদক অদিতি আদ্রিতা সৃষ্টি বাংলাদেশ পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর জন্মলগ্ন থেকেই এই শহীদগণ জামাত-শিবির তথা সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করে ।

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯, সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রনেতামনিরসহ বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ)-এর তপন, জুয়েল, মুকিম, ইয়াসির আরাফাত পিটু ও জালাল নিহত হয়েছেন। শিবির নিষিদ্ধের ঘটনায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ)  সাধারণ সম্পাদক মাসুদ আহাম্মেদ বাংলাদেশ পোস্টকে বলেন, ছাত্রলীগের(জাসদ) বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, জেলা, মহানগর কমিটির অসংখ্য নেতা শিবিরের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। সন্ত্রাসবাদী জামায়াত -শিবির নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি ছাত্র জনতার দীর্ঘদিনের দাবি ও আন্দোলনের বিজয়।

ইসলামী ছাত্রশিবিরের হাতে শুধু প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন কিংবা সংস্কৃতি কর্মীরাই নয়, হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তাদের রাজনৈতিক সহযোগী বিএনপি’র ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের একাধিত নেতা।

১৯৮৯ সালের ২৬ আগস্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক হাবীবুর রহমান কবির, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. এনামুল হকের ছেলে ও ছাত্রদল নেতা মোহাম্মদ মুছা, ছাত্রদল নেতা ও জাসাস রাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক আমান উল্লাহ আমানকে কুপিয়ে হত্যা করেছে ছাত্রশিবির। 

যদিও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ছাত্রশিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের ঘটনায় সরাসরি মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বাংলাদেশ পোস্টকে বলেন, চলমান ছাত্র জনতার প্রতিরোধ সংগ্রামকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য  অবৈধ সরকারের এজেন্ডা। সে এ বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই।

প্রসঙ্গত, ১৯৭১ এর পূর্বে জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংস্থার নাম ছিল ইসলামী ছাত্রসংঘ থাকলেও স্বাধীন দেশে নিষিদ্ধ হলে ১৯৭৭ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি "বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির" নামে আত্মপ্রকাশ করে। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাসির দণ্ডপ্রাপ্ত মীর কাশেম আলী।