ন্যাভিগেশন মেনু

কপিলমুনি হানাদারমুক্ত দিবস ৯ ডিসেম্বর


আজ ৯ ডিসেম্বর, খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি হানাদারমুক্ত দিবস।

এই দিন ‘মিনি ক্যান্টনমেন্ট’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া কপিলমুনির রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর সুরম্য বাড়িতে দক্ষিণ খুলনার অন্যতম প্রধান রাজাকার ঘাঁটি দখলের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর পতন হয়।

কপিলমুনি অঞ্চলের মাটিকে মুক্ত করে লাল সবুজের বিজয় পতাকা উড়িয়েছিলো মুক্তিসেনারা।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কপিলমুনির রায়সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর সুরম্য বাড়িটিকে দখল করে রাজাকাররা সেখানে শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করে। খুলনাঞ্চলের মধ্যে এই রাজাকার ঘাঁটিটি ছিল অনেক বেশি শক্তিশালী।

কয়েকশ রাজাকার এখান থেকেই আশপাশের অঞ্চলে ব্যাপক তাণ্ডব চালাতো। নির্বিচারে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালানো ছিলো তাদের নিত্যদিনের কাজ। তারা গুলি করে হত্যার পর পুড়িয়ে দেয় শত শত নারী, পুরুষ ও শিশুকে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন একাধিকবার এই ঘাঁটিটি দখল করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা অভিযান পরিচালনা করেন, কিন্তু ঘাঁটিটির অবস্থানগত সুবিধা, রাজাকারদের কাছে প্রচুর গোলাবারুদ থাকা, রাজাকারের সংখ্যা বেশি থাকায় এবং রাজাকারদের নির্যাতনের ভয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ সহযোগিতা না করায় অভিযানগুলো সফল হয়নি।

এক পর্যায়ে জীবন বাজি রেখে রাজাকার ঘাঁটিটি দখল করার শপথ নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার আগে রাজাকার ক্যাম্পটি সহযোদ্ধাদের নিয়ে রেকি করেন মুক্তিযোদ্ধা ইউনুস আলী ইনু।

অতি দ্রুত রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের চূড়ান্ত পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। পরিকল্পনায় অংশ নেন ইউনুস আলী ইনু, স ম বাবর আলী, গাজী রহমতউল্লাহ, লেফটেন্যান্ট সামসুল আরেফিন, আবদুস সালাম মোড়ল, শেখ সাহিদুর রহমান কুটু, আবুল কালাম আজাদ, শেখ শাহাদাৎ হোসেন বাচ্চু, গাজী রফিকুল ইসলাম, শেখ আবদুল কাইয়ুম প্রমুখ।

সিদ্ধান্ত হয়, ৫ ডিসেম্বর রাত ৩টায় রাজাকার ক্যাম্পের তিনদিক থেকে একসঙ্গে আক্রমণ করা হবে।

এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধারা শপথ নিয়েছিলেন, রাজাকার ঘাঁটির পতন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা স ম বাবর আলী ও আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বাধীন ৫০ জনের মুক্তিসেনার দলটি নাসিরপুর ব্রিজ পার হয়ে কপিলমুনি বালিকা বিদ্যালয়ে অবস্থান নেন।

রহমতউল্লাহ ও ওমর ফারুক তাঁদের বিস্ফোরক দল নিয়ে রাজাকার ক্যাম্পের দুই পাশে পৌছায়।

আবু ওবায়দার দলটি আরসিএল নিয়ে কানাইদিয়ার পাড় থেকে ক্যাম্পে আক্রমণ করার জন্য তৈরি হয়। ইঞ্জিনিয়ার মুজিবরের নেতৃত্বে একদল অবস্থান নেন আরসনগর। সেখানকার কালভার্ট উড়িয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তাঁদের। নৌ-কমান্ডো বজলুর রহমান ও হুমায়ুনের নেতৃত্বে একটি দল রাজাকার ক্যাম্পের পাঁচিল ও মূল ঘাঁটিতে বিস্ফোরক লাগানোর দায়িত্বে ছিল।

মোড়ল আবদুস সালামের নেতৃত্বে রশীদ, মকবুল হোসেন, সামাদ মাস্টার, জিল্লুর রহমানসহ ২০ জনের একটি দল রাজাকার ঘাঁটির ২৫-৩০ গজ দূরে অবস্থান নেয়; যাতে তাঁরা রাজাকার ঘাঁটির বাংকারে গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে পারেন।

আজিজুল হকের নেতৃত্বে ১০ জনের আরও একটি দল ছিলো পাইকগাছার শিববাটি নদীর মোহনায়। ভাসমান মাইন নিয়ে তাঁরা অপেক্ষায় ছিলেন যাতে নৌপথে রাজাকারদের সহায়তায় কোনো গানবোট আসার চেষ্টা করলে সেগুলো উড়িয়ে দেওয়া যায়।

পরিকল্পনামতো ৫ ডিসেম্বর রাতে সবাই তাঁদের নির্দিষ্ট পজিশনে চলে যান। ভোররাতে শুরু হয় আক্রমণ। রাজাকাররাও পাল্টা জবাব দিতে শুরু করে। রাত শেষ হয়ে ভোর হয়, একটি নতুন দিনের সূচনা। কিন্তু যুদ্ধ থেমে থাকে না। দুই পক্ষেই বেশ গোলাগুলি চলতে থাকে। দিনের আলো বাড়তে থাকে, সূর্যের আলোর তেজের সঙ্গে সঙ্গে দুই পক্ষের আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণও বাড়তে থাকে। বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়; একসময় দুপুরও পার হয়ে যায়; কিন্তু যুদ্ধ থামে না। রাজাকাররা তিন দিক থেকে ঘেরাও হয়ে পড়লেও অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে তাদের প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে থাকে।

এলাকাবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহ, রাজাকারদের তথ্য, ঘাঁটির বর্ণনা দেওয়া, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সহায়তা দিতে অন্যত্র সরিয়ে নিতে সহযোগিতা করে। মুক্তিসেনা ও এলাকাবাসীর সম্মিলিত প্রয়াসের এই জনযুদ্ধে রাজাকাররা সম্পূর্ণভাবেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

যুদ্ধের পর ঘাঁটি থেকে উদ্ধার করা কাগজপত্রে দেখা যায়, ওই রাজাকার ক্যাম্পের মাধ্যমে এক হাজার ৬০১ জনকে হত্যা করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে হত্যা করার জন্য আরো এক হাজার জনের নামের একটি তালিকা পাওয়া যায় ঘাঁটিতে।

মুক্ত দিবসের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুক্তযুদ্ধকালীন বৃহত্তর খুলনার মুজিব বাহিনী প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকু বলেন, ১৯৭১ সালে ৬ ডিসেম্বর ভোররাত থেকে মুক্তিযোদ্ধারা খুলনার দক্ষিণ অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত করার চূড়ন্ত অপারেশন শুরু করেন। কয়েকশ’ মুক্তিযোদ্ধা একযোগে চতুর্দিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে তিনদিন তিনরাত যুদ্ধ করে ৯ ডিসেম্বর দুপুরের দিকে কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্প হানাদার মুক্ত করে।

এ যুদ্ধে ১৫৬ জন রাজাকার ও আলবদর আত্মসমর্পণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। পরে প্রায় ২৫ হাজার লোকের উপস্থিতে গণআদালতের মাধ্যমে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এভাবে শত্রুমুক্ত হয় খুলনার দক্ষিণ অঞ্চল। বিজয়ের আনন্দে মেতে ওঠে মুক্তিকামী জনতা।

কপিলমুনি মুক্ত দিবস উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক আজ দুপুর ১২টায় খুলনার কপিলমুনি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ কাজের উদ্বোধন এবং রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর বাড়িতে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন।

মন্ত্রী বিকেল ৩টায় কপিলমুনি হানাদারমুক্ত দিবস উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগদান করবেন। এ সময় তার সাথে থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ।

এস এ/ এ কে এইচ/এডিবি