ন্যাভিগেশন মেনু

সমুদ্রে মারা যাচ্ছে রাজ কাঁকড়া! ভেসে আসছে সৈকতে


পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের সমাগম নেই। সৈকতে নেই কোন হৈ-হুল্লোর। তাই বালুর আল্পনা ফুটে উঠেছে গোটা সৈকত জুড়ে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত শূণ্যসৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে আপন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে লাল কাঁকড়া ও ছোট কাঁকড়ার দল।

মূল সৈকতে যখন প্রাণ প্রকৃতি হাসছে আপন মনে, বিপরীত চিত্র কুয়াকাটার পশ্চিম সৈকতে। সেখানে মরে পড়ে আছে বিলুপ্ত প্রজাতির রাজ কাঁকড়ার ফসিল। যে কাঁকড়া কয়েক হাজার বছর ধরে সমুদ্রে টিকে আছে অবিক্রিত চেহারায়।

বর্তমানে চিকিৎসাশাস্ত্রে এ রাজ কাঁকড়ার নীল রক্তের চাহিদা যখন বাড়ছে তখন হঠাৎ সমুদ্রে মারা যাচ্ছে এ প্রজাতির কাঁকড়া। একইভাবে সাগরে মৎস্যসম্পদ ধরার সঠিক নিয়ম না থাকায় অবাধে ধরা হচ্ছে ছোট-বড় হাঙ্গর। প্রায়ই কুয়াকাটায় মরে ভেসে আসছে ডলফিন, তিমি ও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির কচ্ছপ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে প্রকৃতিতে ও সমুদ্রসম্পদে ক্রমশ বিরূপ প্রভাব পড়ায় চিন্তিত হয়ে পড়ছে গবেষকরা।

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে গত কয়েক বছরে একাধিক ডলফিন, কচ্ছপ ও তিমি মরে ভেসে এসেছে। সাগরে মারা যাওয়া এ প্রাণিগুলো সৈকতে ভেসে এসেছে প্রায় পচন ধরা শরীর নিয়ে। একইভাবে জীবিত অনেক কচ্ছপকে সাগরে অবমুক্ত করেছে স্থানীয় যুবকরা। তবে এসব ডলফিন, কচ্ছপ ও তিমি মারা যাওয়ার সঠিক কারন উদঘাটনে কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি সরকারিভাবে। শুধু মৎস্য বিভাগ ও গবেষকদের একটি দল সরেজমিন পরিদর্শন করে মৃত ডলফিন, কচ্ছপ ও তিমি মাটিচাপা দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে সাগরের জোয়ারে ভেসে এসেছে মৃত রাজ কাঁকড়ার ফসিল। কুয়াকাটা সৈকতের পশ্চিমে লেম্বরবন ও গঙ্গামতি সংলগ্ন সৈকতে প্রতিটি জোয়ারেই ভেসে আসছে এ মৃত রাজ কাঁকড়া।

একইভাবে সমুদ্রে ইলিশের জালে ধরা পড়ছে প্রচুর হাঙ্গর। প্রশাসনের অভিযানে কিছু হাঙ্গর আটক করা হলেও অধিকাংশ হাঙ্গর বিক্রি হয় বিভিন্ন শুটকি কারখানায়। এ হাঙ্গর ধরা পড়ে পড়ে প্রায় প্রতিদিনই।

রাজ কাঁকড়াগুলো দেখতে অনেকটা ঘোড়ার ক্ষুরের মতো। লিমুনাস গণের অন্তরভুক্ত এর বৈজ্ঞানিক নাম লিমুনাস পলিফিমাস। একে কাঁকড়া বলা হলেও এগুলো দেখতে অনেকটা মাকড়শার মতো। এরা অগভীর, নরম বালি ও কর্দমাক্ত সমুদ্রতলে বসবাস করে। ৯ থেকে ১২ বছর বয়সে এই প্রজাতির কাঁকড়া প্রাপ্তবয়স্ক এবং ১৯ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।

নিশাচর গোত্রের এ কাঁকড়া সমুদ্রের তলদেশে ছোট প্রানি, ও ছোট মাছ শিকার করে থাকে। স্থানীয় জেলেদের কাছে এই এটি দৈত্য কাঁকড়া হিসেবেও পরিচিত।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট খেপুপাড়া শাখার বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক খান বলেন, একসময় বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় লাল ও ধুসর কালো রংয়ের রাজ কাঁকড়া দেখা যেতো। এ কাঁকড়ার রক্ত নীল রংয়ের। মানুষের শরীরের রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে এবং মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি জীবানুমুক্ত করতে এই কাঁকড়ার নীল রক্ত অতুলনীয়। এছাড়া এর শরীরের পেছনে ছোট্ট একটি লেজ রয়েছে। অনেকটা শাপলাপাতা মাছের লেজের মতো। এই লেজ দিয়ে তৈরি হয় ক্যান্সারের ওষুধ। তবে এই কাঁকড়া সমুদ্রে মারা যাওয়ায় কারনটি তাদের ভাবিয়ে তুলছে।

তিনি বলেন, সমুদ্রে হাঙ্গর, কাঁকড়া ডলফিন এভাবে মারা পড়লে সমুদ্রে খাদ্য শৃঙ্খলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় সাগরের তলদেশের পানি গরম হয়ে ওঠায় খাদ্যসংকটে হাঙ্গরের দল গভীর সমুদ্র থেকে উপরিভাগে উঠে আসায় এই সময় কিছু হাঙ্গর ধরা পড়ছে। তবে সামুদ্রিক এই মুল্যবান প্রাণি শিকার বন্ধে কঠোর আইন এবং একইসাথে সমুদ্রে ডলফিন, কচ্ছপ ও কাঁকড়া মারা যাওয়ায় বিষয়ে গবেষনা করা উচিত।

সাগরে মাছ শিকার করা জেলে ইব্রাহিম ও মোতালেব মিয়া জানান, তারা সাগরে নিয়ম মেনেই মাছ শিকার করেন। কিন্তু কোনও ধরনের সামুদ্রিক মাছ শিকার করা যাবেনা এই বিষয়টি তারা জানেন না। এমনকী মৎস্য বিভাগ থেকে শুধু জাটকা ও ইলিশ শিকার বন্ধে মাঝেমধ্যে অভিযান চালায়। তবে জেলেদের যদি সামুদ্রিক মূল্যবান মাছ শিকার করা যাবে না এ বিষয়টি ধারণা দিতেন তাহলে এভাবে হাঙ্গর, কচ্ছপ ও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মৎস্যসম্পদ শিকার করতেন না।

এ বিষয়ে ব্যবসায়ীরা বলেন, জেলেদের কাছ থেকে মৎস্য আড়ৎ বিক্রির পর অবিক্রিত মাছ তারা কিনেন। এ মাছের মধ্যে হাঙ্গরসহ বিভিন্ন মাছ থাকে। হাঙ্গর শুটকি লাভজনক হওয়ায় তারা ছোট-বড় সবধরনের হাঙ্গর কিনেন। তবে হাঙ্গর শুটকির বিষয়ে তাদের কোন নিষেধাজ্ঞা নেই বলে জানান।

কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, হাঙ্গর শিকার বন্য আইনে অপরাধ। তবে রাজ কাঁকড়াসহ মূল্যবান সামুদ্রিক প্রানী শিকার বন্ধে তারাও জেলেদের সচেতন করছেন। তবে সুক্ষ ফাঁসের জালে অনেক মাছ মারা পড়ছে যেগুলো বিক্রি করতে না পেরে জেলেরা সমুদ্র তীরে ফেলে যায়।

গবেষক ও মৎস্য কর্মকর্তাদের দাবী, সমুদ্রের এ সম্পদ রক্ষায় সবার আগে সচেতন করা উচিত জেলেদের। একই সাথে মৎস্য সংরক্ষণ আইনটি কঠোর এবং সমুদ্র ও মৎস্য গবেষণায় আরও সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত।

এম কে আর/এমআইআর/এডিবি/