ন্যাভিগেশন মেনু

অগ্নিঝরা মার্চের ২৮তম দিন:

সারাদেশে চলে হত্যযজ্ঞ, জিয়া নিজের ভুল সংশোধন করে মুজিবের নামে বেতারে বক্তব্য দেন


২৮ মার্চ ১৯৭১। এদিন স্বাধীন বাংলা বেতারের সকালের অধিবেশনে মেজর জিয়া আগেরদিনের গভীর রাতে দেওয়া ভাষণের ভুল সংশোধন করে শেখ মুজিবের নামে পুনরায় বেতারে বক্তব্য দেন। এদিন “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র” থেকে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি মেজর জিয়ার পরামর্শে বাদ দেওয়া হয়।

আগেরদিন সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হওয়া গোলাগুলির শব্দ ভোর হওয়ার সাথে সাথে থেমে যায়। সকাল ৭টা থেকে ১২টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিলের ঘোষণা হলেও পরে সময় বাড়িয়ে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কারফিউ তুলে নেওয়া হয়। ঢাকা শহর পরিণত হয় এক ভূতুরে নগরীতে। সেই কালরাতের পর এদিন দুপুরের দিকে ঢাকা শহরের কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়। আতঙ্কিত দিশেহারা মানুষ ছুটে বেড়াচ্ছে এখানে সেখানে, কেউ স্বজন সন্ধানে কেউ খাদ্যের সন্ধানে। অধিকাংশ মানুষ যারা সরকারি চাকরি, ব্যবসা বা অন্যান্য কারণে একেবারেই ঢাকা ত্যাগে অপারগ, তারা ছাড়া আর প্রায় সকলেই শহর ছেড়ে গ্রামের চলে যাবার ব্যবস্থা করেন।

দুদিন খবরের কাগজ বন্ধ থাকার পর এদিন দ্য পাকিস্তান অবজারভার প্রকাশ হয়। পাকিস্তানি সরকারের বিভিন্ন প্রেস নোটের বরাত দিয়ে তাদের খবরের ভরা ছিল ৪ পৃষ্ঠার কাগজ। এখানেই ছোট্ট করে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তারের খবর বের হয়।

এদিন প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যার প্রতিবাদে এবং স্বাধীনতার প্রত্যয়ে বিশাল সমাবেশ ও বিক্ষোভ করে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাঙালি। লন্ডনের এ সমাবেশে অংশ নেন বিদেশিরাও।

চট্টগ্রামের দক্ষিণ থেকে বেলুচ রেজিমেন্ট, উত্তর থেকে চট্টগ্রাম সেনানিবাস এবং কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে অগ্রসরমান পাকসেনাদের হামলায় বাঙালিসেনা, ইপিআর, পুলিশ ও জনতার প্রতিরোধ ব্যূহ টিকতে পারে না। তাই তাদের পিছিয়ে আসার কৌশল নিতে হয়।

পাকিস্তানি নৌবাহিনী চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর উপর গোলা নিক্ষেপ করে তাদের নৌবহর থেকে।

সারাদেশে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়। দেশের বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা শহরের পুলিশ, ইপিআর, ছাত্র-শিক্ষক, জনতা যার কাছে যা ছিল তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়েন।

এদিন থেকে বরিশালের পেয়ারাবাগান থেকে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে সিরাজ সিকদাররের পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ববাংলা) সর্বহারা পার্টি।

২৮ মার্চ রংপুরের বীর বাঙালিরা লাঠিসোঁটা, তীর-ধনুক, কোদাল, কাস্তে নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করেছিলেন। মিঠাপুকুর অঞ্চলের উপজাতীয় সাঁওতাল তীরন্দাজ বাহিনীরা এই আক্রমণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এমন সময় পাকসেনারা মেশিনগান দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে থাকে। হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষের বুকের তাজা রক্তে নিসবেতগঞ্জ ও তার আশপাশ রক্তাক্ত হয়। সেদিন পাক হানাদারদের গুলিতে ছয় শতাধিক মানুষ শহীদ হন।

সেদিন ছিলো রবিবার। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন এলাকার বিক্ষুব্ধ মানুষ রংপুর সেনানিবাসের আশপাশে সমবেত হতে থাকে। লোক সমাগমে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে যেন সাজসাজ রব পড়ে যায়। মিঠাপুকুর, গঙ্গাচড়া, বুড়িহাট, রানীপুকুর, শ্যামপুর, বলদীপুকুর, তামহাট, পাঠিচড়া, তারাগঞ্জ, সাহেবগঞ্জ, পানবাড়ী এবং অন্যান্য এলাকা থেকে মানুষ বাঁশের লাঠি, দা-কুড়াল, বল্লম, তীর-ধনুক হাতে সেনানিবাসকে চারিদিক থেকে ঘিরে দীপ্ত পদে এগিয়ে চলে। সবার মুখে গগনবিদারী স্লোগান : ‘এসো ভাই অস্ত্র ধরো....ক্যান্টনমেন্ট দখল করো।’

বিক্ষুব্ধ মানুষের ঢল যখন ক্রমশই সেনানিবাসের দিকে ধাবমান, তখন পাকিস্তানি ক্যাপটেন সগীর তার পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ি মেশিনগান সজ্জিত ১০টি সামরিক জিপ অগ্রসরমান মানুষের দিকে তাক করে লাগানোর আদেশ দিলেন। অপরদিকে বাঁধভাঙা মানুষের জোয়ার নিসবেতগঞ্জ পেরিয়ে বালার খাইল এলাকা অতিক্রম করে বর্তমান সেনানিবাস বাজারের কাছে পৌঁছামাত্র মেশিনগানের গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে যায়। অবিশ্বাস্য বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণের মুখে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। একটানা গুলির গর্জন এবং আহত মানুষের আর্তচিৎকার মিলেমিশে আশপাশের পরিবেশকে ভারি করে তোলে। মাত্র পাঁচ মিনিটের গুলিবর্ষণে আনুমানিক ৫০০ থেকে ৬০০ মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।। [অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম শামসুদ্দিনের প্রকাশিত একটি লেখা থেকে]

[তথ্যসুত্র: বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ, মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর]

এডিবি/