ন্যাভিগেশন মেনু

সুয়েজ খালের জন্মকথা


রোমানা আক্তার

মূলত বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য সুয়েজ খাল খনন করা হয়েছে। এই খাল খননের আগে সাগর পথে জাহাজে ইউরোপ থেকে দক্ষিণ এশিয়া আসতে হলে আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে আসতে হতো। এর ফলে মালামাল পরিবহনে বহু সময় ব্যয় হতো। সেই সাথে পরিবহন খরচও বেড়ে যেতো অনেক।

কথিত আছে মিশরের অধিপতি ফারাও নেকো স্বপ্নে নীল নদ থেকে লোহিত সাগর পর্যন্ত দীর্ঘ্য একটি খাল খনন করার দৈববাণী পেয়েছিলেন। এরপর তিনি লক্ষাধিক দাস নিয়ে খাল কাটা শুরু করেন। কিন্তু হঠাৎ কিছুদিন পরেই এই খনন বন্ধ হয়ে যায়। কথিত আছে নেকো অপর একটি দৈববাণীতে জেনেছিলেন যে- এই খাল মিশরের জন্য দুর্ভোগ বয়ে আনবে।

বর্তমানের সুয়েজ ক্যানল হিসাবে যেটি ব্যবহার করা হচ্ছে সেটি খনন করা হয় ১৮৫৯ সালে। কিন্তু প্রাচ্য পাশ্চাত্যকে সংযুক্ত করার প্রয়াস মানুষ জানিয়ে আসছে সুপ্রচীন কাল থেকেই। আজ থেকে ৪ হাজার বছর আগেই লোহিত সাগরকে ভূমধ্যসাগরের সাথে সংযুক্ত করার প্রয়াস পাওয়া যায়। গবেষকদের ভাষ্যমতে, ১৮৫০ খ্রি:পূর্ব মিশরের ক্ষমতায় থাকা ফারাও দ্বিতীয় রামচেজ লোহিত সাগরকে নীল নদের সাথে সংযুক্ত করার জন্য একটি খাল খনন করেছিলেন । তবে ঐ সময় প্রযুক্তি ততোটা শক্তিশালী না হওয়ায় খনন করা খালটির রক্ষনাবেক্ষন সহজ ছিল না। ফলে ক্রমশ কালের গর্ভে খালটি বিলিন হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে নীলনদ এলাকায় মরু এলাকার বালুতে খালটি ভরাট হয়ে যায়। এরপর প্রায় ১২ শত বছর বিভিন্ন যুদ্ধ-বিদ্রোহ , মহামারি মোকাবিলা করতে গিয়ে সুয়েজ খাল নিয়ে ব্যয় করার সময় হয়ে উঠে নি। এরপর খ্রি: পূর্ব  ষষ্ঠ শতকে ফরাও দ্বিতীয় নীবেস পূনরায় খাল খননের কাজ শুরু করেন। কিন্তু তা শেষ করার আগেই তার পতন হয়। মিশরের ক্ষমতা দখল করেন পারস্যের রাজা দ্বিতীয় ক্যারামবেইসেস যার উত্তরাধিকারী হিসেবে ডারিয়াস নিজ উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত খননের প্রকল্পের কাজ প্রথমবারের মত বাস্তবায়িত হয়।

গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডেটাসের বর্ননানুযায়ী,দ্বিতীয় ডারিয়াসেসর খনন করা ঐ খালটি দিয়ে পাশাপাশি দুটি নৌকা চলাচল করতে পারত। দ্বারবাহি ঐ নৌকায় সুয়েজখাল পারি দিতে সময় লাগত টানা ৪ দিন। এই চার’শ বছর পর মিশরের  রাজা দ্বিতীয় চ্যালেনী আরেক দফা খালটি পুনর্গঠন করেছিলেন। কিন্তু ঠিকমত রক্ষানাবেক্ষনের অভাবে খালটি কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। শুধু মিশরীয়রাই খালটি খননের চেষ্টা করেছেন তা নয়। অনেকেই এই খালটি খননের চেষ্টা করেছিলেন।

১৭৯৮ সালে মিশর বিজয়ের পর ফরাসি সেনা প্রধানের দায়িত্বে থাকা নেপোলিয়ান একদল পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছিলেন। এদের কাজ ছিল লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরকে সংযুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয়  সুপারিশ সংগ্রহ করা। নেপোলিয়ানের পর্যবেক্ষন দলটি ভালো করে পর্যবেক্ষণের পর জানায় যে, ভূমধ্যসাগরের তুলনায় লোহিত সাগরের উচ্চতা অন্ততপক্ষে ৩০ গুন ফলে এই দুই জলরাশিকে যুক্ত করা হলে পুরো নীলনদ অবিবাহিকা বন্যায় তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে বলে জানিয়েছেন ঐ পর্যবেক্ষক দল। এই ভূল পর্যবেক্ষণের ফলে শুধু নেপোলিয়নই খনন বাদ দেননি। পরবর্তী ৫০ বছর এই খননের কথা কেউ চিন্তাও করেননি। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা মাপতে ভূল করলেও সেই পর্যবেক্ষক দল প্রথম ৪ হাজার বছর পুরোনো ঘাটের চিহ্ন  খুঁজে পেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ১৮৪৭ সালে আরেকটি ফরাসি পর্যবেক্ষকদল সঠিকভাবে হিসেব কশে জানান যে, লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় একই। যার ধারাবাহিকতায় ১৮৫৪ সালে খালটি নতুন করে খননের কাজ হাতে নেন ফরাসি কূটনৈতিক ফার্দিনান্দ দে লেসেপস। তার সেই পরিকল্পিনায় সমর্থন জানান ফরাসি রাজা ৩য় নেপোলিয়ন। ফ্রান্সের এই সমর্থনের খবর পেয়ে ব্রিটিশরা খাল খনন প্রকল্পের বিপক্ষে অবস্থান নেন। কারন আর কিছুই নয়, ঐ সময় বিভিন্ন এলাকায় উপনিবাস স্থাপনের অসুস্থ প্রতিযোগির ফলে সেই সময় ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সম্পর্ক ছিল সাপ নেওরার মত। তাই এক দেশ কিছু সমর্থন করলে অপর দেশ তার বিরোধিতা করবেই। এ নিয়ে ফরাসি কুটনীতিবিদ লেসেপের সাথে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড টমাস গনমাধ্যমে বাকযুদ্ধে জড়িয়েছিলেন। কুটনীতিবিদ লেসেপকে জীবনের অনেক ঝুঁকি মেনে নিয়ে এভাবেই আর্থিক তহবিল সংগ্রহ করতে হয়। ৫ বছর পর ১৮৫৯ সালে শুরু হয় প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। দীর্ঘ ১০ বছর পর শেষ হয় এই প্রকল্প। মজার ব্যাপার হলো খালটি খননের বিরোধিতা করলেও খনন কাজ শেষ হওয়ার মাত্র ৬ বছরের মাথায় সুয়েজ খালের শতকরা ৪৪ ভাগ শেয়ার মিশরের কাছ থেকে জোড়পূর্বক নামমাএ মূল্যে কিনে নেন ব্রিটিশ সরকার। যার ধারাবাহিকতায় ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত মিশরে অবস্থিত এই খালটি নিয়ন্ত্রন ছিল ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের হাতে। ঐ মিশরের প্রেসিডন্ট জামাল আবদেল নাছের খালটিকে জাতীয়করন করেন। যার ফলে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সুয়েজ কেরাইসিস নামে এক সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। যার ফলে মিশর ও ইসরাইলের মধ্যে কয়েক দফা যুদ্ধ হয়।

ঊনবিংশ শতকে এই সুয়েজ খালটি খননে বিপুল শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। ঐ সময় প্রচলিত  ইন্জিনের ব্যবহার থাকলেও এ অবস্থায় খরচ বাঁচাতে খাল খনন গঠিত প্রতিষ্ঠান টি নাম মাত্র মজুরিতে কৃষক ও নিম্নবিত্ত  মানুষকে শ্রমিক হিসাবে নিয়োজিত করেন। কাজ না করলে মারধোর , নির্যাতন করারও ইতিহাস রয়েছে।

ধারনা করা হয় ২০০ কি:মি: দৈর্ঘ এই খালটির প্রথম ৫০ কি:মি: শ্রমিকরা শুধু কোদালের সাহায্যে খনন করেছিল। ১৯৬৯ সালে সুয়েজ খাল খননের কাজ সমাপ্ত হলে তা উদ্ভাবনের জন্য একটি মানব মূর্তির সদৃশ একটি বাতিঘর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন ফরাসি কুটনীতিবিদ  ফারদিনানদ দে লেসেপসকে  নিজের সেই স্বপ্ন পূরণের দ্বায়িত দেন ফরাসি ভাস্কর্য নির্মাতাকে। ভাস্কর্যটির নাম রাখা হয়েছিল “ইজি বিরিং লাইফ টু এশিয়া”। অগস্টের ভাষ্যনুযায়ী , ভাষ্কর্যটি ছিল ৯০ ফুট উঁচু এক নারী যার পরনে রয়েছে মিশরদের কৃষকদের ব্যবহৃত আলখাল্ল। তার একহাতে একটি মশাল থাকবে যার আলো একসাথে বাতিঘরের কাজও করবে। শেষপর্যন্ত অগাস্টের ভাস্কর্যটি সুয়েজ খালের প্রবেশপথে বসানো হয়নি। কিন্তু ভাস্কর্যটির বর্ননা শুনে অনেকেই হয়তবা বুঝতে পেরেছেন যে ভাস্কর্যটি শেষ পর্যন্ত নিউইর্য়ক বন্দরে মাথা উঁচু করে দাঁরিয়ে রয়েছে। পরবর্তীতে যার নাম দিয়েছে “স্টাচু  অপ লিবার্টি”। ১৮৮৬ সালে বিখ্যাত এই মূর্তিটি স্থাপন করা হয়।

২০১৪ সালে সুয়েজ খালটি সম্প্রসারের উদ্দোগ নেয় মিশরের সরকার। খালটির ৬৫ কি: মি: দৈর্ঘ্য জুরে খালটির প্রস্থ বাড়ানো হয়। এটি সম্প্রসারণের ক্ষেএে সরকারের ব্যয় হয়েছিল সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার । মিশরের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে ব্যয়হুল নির্মাণ প্রকল্প । এই খালের প্রস্থ বাড়ায় দৈনিক ৯৭ টি করে জাহাজ অতিক্রম করতে পারে।

লেখক:রোমানা আক্তার

ওআ/