ন্যাভিগেশন মেনু

হলুদ-তুলসী-জোয়ান-দারচিনি-লবঙ্গ-আদার পাঁচনেই হটলো করোনা


একে লকডাউনের তার ওপর আবার রাত বেশির দিকে গড়াচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁইছুঁই। শহর তখন ঘুমিয়ে পড়ার তোড়জোড়ে ব্যস্ত। এমন সময় হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ ঢুকল ডাক্তারবাবুর। 

সুদূর বাহরিন থেকে আসা ভয়েস মেসেজ। বেঁচে থাকার কাতর আর্তনাদ নিয়ে। “ডাক্তারবাবু বাঁচান! আমার করোনা হয়েছে।” প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কিমি দূর থেকে আসা কী করুণ সে আর্তি! বেঁচে থাকতে চেয়ে কলকাতার এক ডাক্তারবাবুর কাছে করোনামুক্তির দাওয়াই চাইছেন বাহরিন প্রবাসী মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।‘এসওএস’ বার্তা পেয়ে দেরি করেননি ডাক্তারবাবুও। ভয়েস মেসেজেই পাঠিয়েছেন প্রেসক্রিপশন। কিন্তু সে ওষুধ তো ভারতীয় প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুযায়ী। বিদেশ বিভুঁই, তাও আবার মধ্যপ্রাচ্যের মরুরাজ্য বাহরিন! কী করে মিলবে সে ভেষজ ওষুধ? 

তাই প্রেসক্রিপশনের সঙ্গে বাতলে দিয়েছেন ওষুধ তৈরির উপকরণ ও অনুপান। হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো সেই প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ খেয়েই করোনাযুদ্ধে সপরিবার জয়ী ১৪ দিনের বিধিবদ্ধ সময়ের অনেক আগেই। 

দাবি প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ারের। পীযূষ প্যাটেল। বাড়ি গুজরাতের গান্ধীনগরে। বাহরিনের একটি তৈল শোধনাগারে উচ্চপদে আসীন। স্ত্রী হর্ষ প্যাটেল, দুই মেয়ে অদিতি ও মাইরা বাহরিনেই থাকেন। ১৪ এপ্রিল পীযূষ কোভিড পজিটিভ হন। 

তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় কোয়ারান্টাইন সেন্টারে। দু’দিন পর দুই মেয়ের শরীরেও কোভিডের উপসর্গ দেখা দেয়। টেস্ট হয়। রিপোর্ট পজিটিভ আসে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে প্যাটেল পরিবারের। একে বাড়ির কর্তা নেই। তার উপর মেয়েরা আক্রান্ত। সরকারের বিশেষ অনুমতি নিয়ে মেয়েদের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন মা হর্ষ। কিছুদিনের মধ্যে তিনিও পজিটিভ হন। পূর্ণ হয় বিপর্যয়ের ষোলো কলা!

এই বিপদের দিনেই সঞ্জীবনী হয়ে উঠল শ্যামবাজারের ওষুধ। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে জে বি রায় আয়ুর্বেদ কলেজ। এখানকার চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. পুলককান্তি করের ওষুধ খেয়েই এখন সপরিবার করোনামুক্ত পীযূষ। 

তিনি জানালেন, “কোয়ারান্টাইন সেন্টারে গিয়েই প্রথম ডা. করকে ভয়েস মেসেজ করি। খুব অসহায় লাগছিল। ফোনে ওঁকে পাব কি না বুঝতে পারছিলাম না।” পুলকবাবু অবশ্য ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পীযূষকে হোয়াটঅ্যাপে প্রেসক্রিপশন পাঠিয়ে দেন। 

কিন্তু সমস্যা যে অন্যত্র! কোয়ারান্টাইনে বন্দি অবস্থায় ওষুধ মিলবে কোথায়? তাও আবার ভারতীয় ভেষজ ওষুধ! আবার ভয়েস মেসেজ আসে পুলকবাবুর কাছে। সমস্যার সুরাহা করেন তিনি। পীযূষবাবুর থেকে জেনে নেন, কোয়ারান্টাইনে থেকে তিনি কী কী ভেষজ জোগাড় করতে পারবেন। সেই অনুসারেই ওষুধ তৈরির ফর্মুলা দেন।

রবিবার বাহরিন থেকে পীযূষবাবু ফোনে ‘সংবাদ প্রতিদিন’কে জানান, “হলুদ, তুলসী, জোয়ান, দারচিনি, লবঙ্গ, আদা জোগাড় করতে পেরেছিলাম। তাই দিয়েই ডা. করের ফর্মুলা মেনে পাঁচন বা ক্বাথ তৈরি করি। দিনে তিন-চারবার করে খাচ্ছিলাম। কোয়ারান্টাইন সেন্টারে ইলেকট্রিক কেটলি ছিল। তাতেই তৈরি করা হয়েছে পাঁচন।”

পীযূষবাবু জানান, “পাঁচন সেবন ছাড়াও ডাক্তারবাবুর কথামতো আরও তিনটি নিয়ম মেনে চলেছিলাম। দিনভর আদা ফোটানো গরম জল পান, নুনজল দিয়ে দিনে চার-পাঁচবার গার্গল করা, আর বারতিনেক ভেপার নেওয়া।” এই ফর্মুলাতেই ১৭ এপ্রিল মাত্র তিনদিনের মাথায় ‘নেগেটিভ’ হয়ে যান পীযূষবাবু। 

বড় মেয়ে অদিতি ‘নেগেটিভ’ হন ২২ এপ্রিল। কিন্তু ২৩ এপ্রিল ফের ‘পজিটিভ’ হন। ২৫ ও ২৬ এপ্রিল আবার পরপর দু’টি পরীক্ষার রিপোর্ট ‘নেগেটিভ’ হওয়ায় করোনামুক্ত বলে ঘোষণা করা হয় অদিতিকে। মেয়েদের সঙ্গে থাকার সুবাদে পীযূষবাবুর স্ত্রী হর্ষও ২৮ এপ্রিল পজিটিভ হয়েছিলেন।

 তিনিও পুলকবাবুর ওষুধের জোরে চারদিনে নেগেটিভ হন। করোনামুক্ত হতে সবচেয়ে বেশি সময় নেয় ছোট মেয়ে মাইরা। পুলকবাবু জানান, “ওদের বাড়িতে ‘বালচতুর্ভদৃকা’ ও ‘সুদর্শন ঘনবটি’ ছিল। এই দুই ধ্রুপদী আয়ুর্বেদ ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল মেয়েদের। 

কিন্তু দেড় বছরের মাইরাকে ঠিকমতো ওষুধ খাওয়ানো যাচ্ছিল না। তাই সবাই তিন-চারদিনের মধ্যে নেগেটিভ হলেও মাইরা করোনামুক্ত হয়েছে ৩০ এপ্রিল। ১২ দিনের মাথায়।

পীযূষবাবুর করোনা আক্রান্ত হওয়ার দিন, মানে ১৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি করোনাযুদ্ধে আয়ুশ ক্বাথের কথা বলেছিলেন। সেই মতোই আয়ুশ মন্ত্রক গাইডলাইন তৈরি করে রাজ্যগুলিকে পাঠায়। কেরল, গোয়া, জম্মু-কাশ্মীর, হরিয়ানা, তামিলনাড়ু, রাজস্থান সরকার কোভিড-যোদ্ধাদের সেই ক্বাথ খাওয়ায়। কিন্তু, আয়ুশ ক্বাথ খেয়ে করোনাযুদ্ধে সপরিবার জিতে যাওয়ার নজির সম্ভবত প্রথম।

এস এস