দেশের বৃহত্তম ও মৎস্য ভান্ডার হিসেবে খ্যাত কিশোরগঞ্জের নদী, হাওর ও খাল-বিলে এসেছে নতুন পানি। পানি আসার সঙ্গে সঙ্গে মা মাছ ও পোনা মাছ ধরতে নেমে পড়েছেন জেলেরা। নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল দিয়ে নির্বিচারে মা ও পোনা মাছ নিধন করছেন তাঁরা। প্রকাশ্যে এসব মাছ নিধন হলেও প্রশাসন এক্ষেত্রে নির্বাক। তবে প্রশাসন বলছে, অবৈধ জাল দিয়ে মা মাছ ও পোনা মাছ নিধনকারীদের বিরুদ্ধে জোরদার অভিযান চলছে।
কিশোরগঞ্জ সদর, করিমগঞ্জ, ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, তাড়াইল, কটিয়াদী, পাকুন্দিয়া, ভৈরব উপজেলার নদী, হাওর ও খাল-বিলে পানি আসায় বিভিন্ন হাট বাজার ও মৎস্য আড়তে দেখা গেছে ডিমে পেট ভরপুর টেংরা, বাতাসি, পুঁটি, মলা, শোল, মাগুড়সহ বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির ডিমওয়ালা মা ও পোনা মাছ প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে।
হাওরের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার বালিখোলা পাইকারি মাছের বাজারে বিক্রি হচ্ছে রুই, কাতল, বোয়ালসহ বিভিন্ন প্রজাতির পোনা মাছ। বাজার সংলগ্ন ধনু নদীসহ বিভিন্ন হাওর থেকে চায়না দুয়ারী জাল দিয়ে এসব পোনা মাছ ধরা হয়েছে। এছাড়া অসাধু জেলেরা বিলের বিভিন্ন পয়েন্টে বাদাই ও কারেন্ট জালসহ মাছ ধরার বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে দিনে ও রাতে মা মাছ শিকার করে হাট-বাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি করলেও মৎস্য বিভাগ কিংবা জেলা প্রশাসনের নেই কোনো নজরদারি। যেন এসব দেখারই কেউ নেই।
মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, সাধারণত জুন-জুলাই মাসে ডিম ছাড়ে মা মাছগুলো। নতুন পানি আসতে শুরু হলেই মাছগুলো ডিম ফুটাতে থাকে। এ সময়টাতে মাছ ধরা একেবারেই নিষিদ্ধ। ১৯৫০ সালের মৎস্য আইন অনুযায়ী, ডিম এবং মা মাছগুলো শিকার আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু পানি আসার সঙ্গে সঙ্গে মাছ শিকারে নেমে পড়েন জেলেরা। এতে জেলেদের জালে ধরা পড়ে নষ্ট হচ্ছে ডিমগুলো।
জেলা মৎস্য অফিসের তথ্যমতে, বর্তমানে জেলায় নিবন্ধিত কার্ডধারী জেলের সংখ্যা ৮৭ হাজারের ওপরে। আরও কিছু জেলে কার্ডের জন্য আবেদন করেছেন। এগুলোর অনুমোদন দেওয়া হলে জেলের সংখ্যা ৮৮ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। তবে কিশোরগঞ্জ হাওরবেষ্টিত জেলা হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষের সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ হয়ে যায়।
জেলা মৎস্য কার্যালয় জানায়, কিশোরগঞ্জের হাওরে ২০২০-২১ অর্থবছরে ২২ হাজার ৪৭৪ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৪ হাজার ৬৩১ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৮ হাজার ২১ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। ৩১ হাজার ৯৭৮ মেট্রিক টন উৎপাদিত হয়। সরকারি ও বেসরকারি হিসেবে জেলায় ২৬টি নদনদী, ৩৪৭ বিল ও ১২২টি হাওর রয়েছে। এ ছাড়া বিল নার্সারির সংখ্যা ২২ এবং অভয়াশ্রম রয়েছে ১১টি।
স্থানীয়রা বলছেন, এসব জালের ব্যবহার চলতে থাকলে হাওরে মাছের সংকট দেখা দিবে। বিভিন্ন নদ-নদী থেকে বড় মাছ ধরার পাশাপাশি মেরে ফেলা হচ্ছে ছোট ছোট মাছের পোনা। ধনু নদীর তীরে অবস্থিত বালিখোলা বাজারে দেখা গেছে, বিপুল পরিমাণ পোনা মাছ বিক্রি হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে বোয়াল মাছের পোনা। সস্তায় বিক্রি হচ্ছে এসব পোনা মাছ। এতে করে হাওড়ে এক সময় মাছের সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মৎস্যজীবী ও মৎস্য শিকারীরা স্থানীয় সুফলভোগীদের সঙ্গে যোগসাজসে প্রতিদিন দুপুরে, সন্ধ্যা রাতে এবং ভোর রাতে অবাধে পোনা ও মা মাছ নিধন করে থাকে। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পোনা ও মা মাছ নিধন বন্ধে তেমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় প্রতিদিন শত শত মৎস্যজীবী ও মৎস্য শিকারী নিষিদ্ধ ওই জাল দিয়ে বিল থেকে ছেঁকে মাছ শিকার করছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন জাল ব্যবসায়ী জানান, জেলায় সব চেয়ে বড় কারেন্ট ও চায়না জালের পাইকারি ব্যবসা হয় জেলা শহরের বড়বাজার, ভৈরব, করিমগঞ্জ ও তাড়াইল উপজেলার কয়েকটি বাজারে। কয়েকজন ব্যবসায়ী এসব দোকানে লাখ টাকার অবৈধ কারেন্ট ও চায়না জালের পাইকারির ব্যবসা করে থাকেন। তাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা মূল্যের কারেন্ট ও চায়না জাল ক্রয় করে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন উপজেলার বাজারে খুচরা বিক্রি করে থাকেন।
কয়েকজন জেলে বলেন, এমন কোনো মাছ নেই যা এই জালে ধরা পড়ে না। কিছু লোভী শ্রেণির লোক এভাবে মা মাছ ও পোনা মাছ নিধন করছে। আপনি একটা প্রকৃত জেলেও দেখাতে পারবেন না যে পোনা মাছ ও মাছ মারে। আমরা চাই যারা এমন কাজ করে তাদের আইনের আওতায় আনা হউক। তাহলে আর মাছের আকাল পড়বে না।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, উপজেলাওয়ারী প্রতি সপ্তাহেই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এটা রুটিন ওয়ার্ক। গত জুন মাসে পুরো জেলায় অভিযান হয়েছে ৪০টি ও মোবাইল কোর্ট ১১টি। আর জরিমানা করা হয়েছে ২ জনকে ২ হাজার করে মোট ৪ হাজার টাকা। কারেন্ট জাল জব্দ করা হয়েছে ১৭৭ পিস যার দৈর্ঘ্য ১৪ হাজার ৪০০ মিটার। চায়না জাল জব্দ করা হয়েছে ৭৬৪৪টি যার দৈর্ঘ্য ৮২ হাজার ৭৮৭ মিটার। জুলাই মাসের পরিসংখ্যান এখনই বলা যাচ্ছে না তবে জুন মাসের চেয়ে বেশি অভিযান ও মোবাইল কোর্ট হয়েছে এবং প্রচুর কারেন্ট ও চায়না জালও জব্দ হয়েছে।
কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিজাবে রহমত বলেন, নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। যারাই কারেন্ট জাল ও চায়না জাল দিয়ে মা মাছ ও পোনা মাছ নিধন করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।