ন্যাভিগেশন মেনু

বই আলোচনা:

হিমালয় পেরিয়ে


‘হিমালয় পেরিয়ে’ একটি জীবনঘনিষ্ঠ উপন্যাস। একে শুধু উপন্যাস বললে সম্পূর্ণটা বলা হবে না, এটা হলো জীবনের পরম বোধের প্রকাশ। এ যেন মানব জীবনের সংগ্রামের অবিনাশী গাথা/দক্ষিণ অঞ্চলের  (দেশের) এক অবিনাশী জীবনের কাহিনি একজন  মানুষের জীবনের কঠিন পরিক্রমা, যা পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ পায় সংগ্রাম ও যন্ত্রণাকে কীভাবে, কোন উপায়ে বিজয়ী করা যায়।    

উপন্যাসে নায়ক চরিত্র রিহান। রিহানের শিশুবেলা, কৈশোর, যৌবনের অমিত সম্ভাবনা জীবনের ইতিবৃত্ত এই উপন্যাস হিমালয় পেরিয়ে। সারা গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য হলো রিহানের সংগ্রামময়তা, তার সাধারণ জীবন থেকে সিএ পাস করার বিপুল কাহিনি। আমরা ধরে নিতে পারি, দেশের দক্ষিণাংশের দক্ষিণ আটুলিয়া থেকে খুলনা শহরের পরিক্রমা। এরপর ঢাকা তথা মহানগর বা কাঁঠালবাগান সিএ মেস।

রিহানের জীবন কোনোভাবেই সহজ সাধারণ ছিল না। জীবনের পূর্ণতা লাভের জন্য তার সঙ্গে এসেছে বিপুল বাধা আর হিমালয় সমান বাধার প্রাচীর। রিহানের সঙ্গে রয়েছে শেখর, সুদীপ, দীপন, নিশাদ, আতিক, আরিফ, রায়হান, সারোয়ার, আরিফ প্রমুখ। আর শিক্ষক চরিত্র হিসেবে এসেছে সাদমানের মতো দায়িত্বশীল লোকেরা।

গ্রামীণ বাল্য-প্রেমের আবেশে রিহান ভালোবেসেছিল সুহাকে। এই প্রেম শুধু প্রেম নয়- সংগ্রামের প্রাঞ্জল পারিভাষিক কাহিনি। কিন্তু একদিন এই নিবিড় বাল্য-প্রেম হলো ব্যর্থতায় নিমজ্জিত। 

চাকরি ও পেশাগত সমস্যার সমাধান করতে না পারায় গ্রাম পারিপার্শিক আর অভিভাবকেয়া প্রেমিকা সুহাকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় অন্যত্র। এই বিষয়ে রিহানের কিছুই করার ছিল না। ছিল ব্যর্থতার আগুনে পুড়িয়ে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। 

উপন্যাস শিল্পী মোঃ সিরাজুল ইসলাম এফসিএ তার নিপুণ হাতের কৌশলে তা প্রকাশ করেছেন অনাবিল ভাষায়। সুহার প্রেমের ব্যর্থতা নিয়ে ঔপন্যাসিক যে ভাবে আভাষিত করেছেন তা যেন এক অতি বাস্তবিক কাহিনির অংশ। ‘লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে রিহান পরদিন আবার সুহাদের গ্রামে গেল এবং ভাই ও বাবার সামনে পড়লো। 

সুহার ভাইতো রাগে রীতিমতো অগ্নিশর্মা হয়ে ওকে মারতে এলো এবং অনেক অপমান করলো। সুহার বাবা না থাকলে নির্ঘাত রিহানের কপালে প্রহার জুটতো। সুহার বাবা রক্ষা করলেন এ যাত্রা।’

উপন্যাস শিল্পী মোঃ সিরাজুল ইসলাম এফসিএ বলেন, ‘দুপুরের আলোকোজ্বল দিন ওর কাছে (রিহানের কাছে) মনে হলো ঝাঁপসা, বিষণ্ণ। বিবর্ণ ধূসর কোনো এক কুহোলিকাময় প্রান্তর। সে প্রান্তরের বালুতে ছড়িয়ে আছে মরুঝড়ের মধ্যে দিশাহীন উড়ে যাওয়া গন্তব্যহীন লক্ষ কোটি কণা।

এরপরের কাহিনি উত্তেজনাহীন। তবে তা ছিল বিষাদে সিক্ত, জীবনের গোপন ইচ্ছের প্রতিবিম্ব। রিহান তার মার খেতে যাওয়ার কাহিনি জানালো মোবাইলে বন্ধু রিপনকে। রিপন শুধু জানালো রিহানকে ‘দোস্ত। এই হলো জীবন।’

প্রেমে গভীর বেদনা ও ব্যর্থতার ব্যথায় বিষণœ হলো রিহানের মন; কিন্তু তার এই বিষাদের কাহিনি তো কাউকে প্রকাশ করার নয়। শেষ পর্যন্ত তাকে ফিরতে হবে ঢাকার জীবনে। তার জীবনকে করতে হবে সফল ও অর্থময়, কোনো না কোনোভাবে রিহান তার সাফল্য আনতে চায় জীবনের জন্য। তাকে সিএ পাস করে এফসিএ করতেই হবে।

রিহানের ঢাকা ফেরার কাহিনি অনন্য বেদনা ও বিষাদের পিচ্ছিল পথ হয়ে আছে। উপন্যাস শিল্পী মোঃ সিরাজুল ইসলাম এফসিএ রিহানের ঢাকায় ফেরার যে ছবি অঙ্কন করেছেন তা অনন্য বিভায় আলোকিত :

‘আগামীকাল সুহার বিয়ে। রিহান আজ রাত্রিতে চলে যাবে ঢাকায়। রাতের বাসে চড়ে বসলো ও। রাতের গাড়ি ওর কাছে বড় অদ্ভূত লাগে। এ রাত প্রাচীন পৃথিবীর নতুন রাত। কারো কাছে আসে স্বপ্ন হয়ে, কারো কাছে আসে স্বপ্নভঙের বেদনা নিয়ে।....সেই প্রদতর আকাশ ফুঁড়ে নামা তীব্র শিলাবৃষ্টির বরফ যেমন গলে যায় সহজাত ভঙিমায়, প্রভাত সূর্যের কিরণে শিশির যেমন মিলিয়ে যায় শূন্যে, প্রখর রৌদ্র তাপে জমাটবাঁধা বরফ যেমন মিলিয়ে যায় বাতাসে সুহা তেমনি মিলিয়ে গেছে অসীম শূন্যতার মাঝে তার জীবন থেকে চির দিনের জন্য। 

হিমবাহের কঠিন বরফ কখন যে গলে পানি হয়েছে আর সেই পানিও বাষ্প হয়ে উড়ে গেছে আকাশে বিন্দুমাত্রও বুঝতে পারেনি রিহান। জীবন কী এভাবেই সবাইকে পরাজিত করে! না, সবাইকে না। কেউ কেউ বিজয়ী দলেও থাকে।’

মোঃ সিরাজুল ইসলাম এফসিএ তার বক্তব্যের শেষাংশে রিহানের জীবনের গভীর প্রত্যয়ের কতা জানিয়ে দিয়েছেন, ‘কেউ কেউ বিজয়ী দলেও থাকে’।

‘হিমালয় পেরিয়ে’ উপন্যাসটি ভাষার লালিত্যে, কাহিনির চমৎকারিত্বে অনন্য বলে মনে করি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক যুবক যেভাবে তার জীবনকে সফল ও ঊর্ধ্বগামী করে তুলেছেন তেমনি কথাশিল্পী হিসেবেও মোঃ সিরাজুল ইসলাম এফসিএ সার্থক এবং আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন- তা সহজেই বলা যায়।

‘হিমালয় পেরিয়ে’র চেয়ে যদি ‘হিমালয়ের মতো বাধা  পেরিয়ে’ লেখা হতো তা আরো সুন্দর হতো। তবে ভাববাচ্য হিসেবে বিষয়টি অনুধাবন করা যায়। বইটি শুধু দক্ষিণ আটুলিয়াবাসীর কাহিনি নয়; এই কাহিনি বাংলাদেশবাসীর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে চলবে। 

এটি মোঃ সিরাজুল ইসলাম এফসিএর লেখা একটি উপনাস সিকোয়েন্সের প্রথম খ-। জানা গেছে, তার লেখা এই সিকুয়েন্সে আরো দুটি উপন্যাস রয়েছে। এই লেখার মধ্যে দিয়ে লেখক তার কঠিন পেশাদারি কর্মের জন্য যে প্রাণান্ত সাধনা করা প্রয়োজন তা অতি নৈপুণ্যের সঙ্গে মানিয়ে দিয়েছেন। 

তাই এই কাজকে অনন্য- কর্ম হিসেবে সহজেই গণ্য করা যায়। এই রচনা প্রসঙ্গে আরো একটি বিষয়ে আলোকপাত করতে পারি, তাহলো- আমাদের দেশের উঁচু পেশাদারিকে উপজীব্য করে সাহিত্যকর্ম করেন তাহলে তা আরো উপকারে আসবে।

মোঃ সিরাজুল ইসলাম এফসিএ হিমালয় পেরিয়ে গ্রন্থে উৎসর্গ অংশে এক মহতী উদ্যোগের কথা উচ্চারণ করেছেন :

‘একটি ১ কি.মি. রাস্তা। দক্ষিণ আটুলিয়া সংযোগ সড়ক। আমার সারা জীবনের দুঃখ। এই রাস্তার ধুলো, মাটি আর কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পথ বেয়ে বেড়ে উঠেছে আমার শৈশব, কৈশোর থেকে শুরু করে জীবন যৌবনের বর্তমান পর্যন্ত। রাস্তাটি আজো পাকা না হওয়ার কষ্টে সমগ্র গ্রামবাসীর সাথে আমিও দারুণভাবে ব্যথিত। 

অথচ গণ্যমান্য ব্যক্তি থেকে শুরু করে সরকারের শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে বছরের পর বছর ধরনা দিয়েও হয়নি দক্ষিণ আটুলিয়াবাসীর এই স্বপ্ন পূরণ। তাই এই বইয়ের বিক্রয়লব্ধ সমস্ত অর্থ দিয়ে রাস্তাটি পাকা করা আমার একটি দুঃসাধ্য এবং ব্যতিক্রমী স্বপ্ন’। এই বিষয়ে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

গ্রন্থটির প্রকাশনার মান উন্নত। সর্বোপরি ধ্রুব এষ-এর প্রচ্ছদে গ্রন্থটি শোভিত ও মার্জিত।

-মহাসিন হোসাইন

(হিমালয় পেরিয়ে। মোঃ সিরাজুল ইসলাম এফসিএ। পঞ্চম মুদ্রণ (প্রকাশ) : জানুয়ারি ২০১৯। প্রকাশক : অমর হাওলাদার বাবুল

১/এ পুরানা পল্টন লাইন, ঢাকা-১০০০

মোবাইল : ০১৭১২ ৫৭৮৬৫৯

প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ, মূল্য ৪০০ টাকা।)

এস এস