ন্যাভিগেশন মেনু

১০ বছরের মধ্যে ছুটি কাটালেন সাড়ে ৭ বছর


চাকরিতে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ছুটি কাটানো ও পদোন্নতি, ব্যক্তিগতকাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদের অবৈধ ব্যবহারসহ নানা অভিযোগ উঠেছে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহীন হাসান চৌধুরীর বিরুদ্ধে।

এক ধরনের ছুটি কাটিয়ে পরে অন্য ধরনের ছুটিতে পরিবর্তন করেছেন তিনি। এমনকি করোনকালীন সময়ে সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কোন ছুটি না নিয়েই অস্ট্রেলিয়া গিয়ে প্রায় ৩ মাস পর দেশে ফিরেছেন।

এভাবে গত ১০ বছরে বিভিন্ন মেয়াদে প্রায় সাড়ে ৭ বছর ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া গেছেন তিনি। তার এই লাগাতার ছুটির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও দাপ্তরিক কাজে ব্যাঘাত ঘটছে বলে মনে করেন একাধিক শিক্ষক।

শাহীন হাসান চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন সারাজীবন আমি নিয়মের মধ্যে চলেছি। অন্যদেরকেও নিয়মের মধ্যে রাখছি। এ কারনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মহল ঈর্যান্বিত হয়ে এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে।

তিনি বলেন, আমার কারণেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া অন্যান্য ডিগ্রি দেয়া হয় যথাযথ নিয়ম মেনে। পড়ালেখা না করে কেউ ডিগ্রি নিতে পারেনা। তা না হলে এতদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি কেনাবেচা হতো।

তিনি আরও বলেন, আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি আমি কখনও কারো প্রভাব খাটায়নি। যথাযথ নিয়ম মেনেই বিভিন্ন  সময়ে ছুটি নিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ী এবং গেস্ট হাউজও ব্যবহার করেছি প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই।

উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলাউদ্দীন বাংলাদেশ পোস্ট’কে বলেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি না নিয়েই করোনা মহামারির মধ্যে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে প্রায় ৪ মাস ছিলেন। এর আগেও নানা অজুহাতে ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া গেছেন।

এছাড়া অনুমতি না নিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ী ও গেস্ট হাউজ ব্যবহার করেছেন। আমি তাকে চিঠি দিয়েছি। সিন্ডিকেটেওে এ বিষয় উঠাতে চেয়েছি। কিক্তু তার প্রভাবের কারণে তা পারিনি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন নিয়ম কানুনই মানেন না। কিছু বলতে গেলেই চড়াও হন। তার কাছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অসহায়’ বলেন উপাচার্য।

সূত্র জানায়- ১৯৯৫ সালের ২৩ মার্চ তৎকালীন বিআইটি, ঢাকাতে (২০০৩ সালে এটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তর করে সরকার) সরাসরি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করেন শাহীন হাসান। এর আগে তিনি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির একটি বেসরকারি পরামর্শক প্রতিষ্টানে প্রকৌশলী হিসেবে ১ বছর ৮ মাস চাকরি করেছেন।

১৯৯৯ সালের ১৬ মে তিনি সহযোগি অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ওই নিয়োগের শর্তে বলা ছিল- প্রার্থীকে প্রকৌশলী অথবা শিক্ষক হিসেবে ৭ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অথচ শাহীন হাসানের ৬ বছরের মতো চাকরির অভিজ্ঞতা ছিল তখন। তিনি চাকরিতে যোগদানের আগে যে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছিলেন, সেটিকেই অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখান ওই সময়। এরপর ২০০৩ সালে ১০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তিনি অধ্যাপক হয়ে যান।

তবে তার পিএইচডি ডিগ্রিকে চাকরির অভিজ্ঞতা হিসেবে কাজে লাগানোর বিষয়ে দ্বিমত পোষন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও জ্যেষ্ঠ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ পোস্ট’কে বলেন, পিএইচডি একটা ডিগ্রি। এর জন্য একজন শিক্ষককে চাকরি ক্ষেত্রে এমনিতেই তো অগ্রাধিকার দেয়া হয়। সেখানে এটাকে প্রকৌশলী হিসেবে চাকরির অভিজ্ঞতা দেখানোর আইনগত কোন সুযোগ নেই। কারণ তিনি তো তখন ছাত্র।

১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৮৮ সালের জুন পর্যন্ত  রাশিয়ায় পড়ালেখা শেষে তড়িৎ কৌশলে ৫ পয়েন্টের মধ্যে ৪.৫৫ পেয়ে এমএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ করেন। তবে এই ডিগ্রির আগে তার বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি সম্পর্কে কিছু বলা নেই।

এমএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশের পর ১৯৯৩ সালের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে উজবেকিস্তান থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে পরের মাসেই দেশে এসে টাঙ্গাইল-১ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির একটি পরামর্শক প্রতিষ্টানে কর্মজীবন শুরু করেন শাহীন হাসান।

বাংলাদেশ পোস্টের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১০ সালের ১৫ মার্চ থেকে গত ১৫ আগস্ট পর্যন্ত মোট ১০ বছর ৫ মাসের মধ্যে শাহীন হাসান প্রায় ৭ বছর বিভিন্ন মেয়াদে ছুটি কাটিয়েছেন। এর বাইরে আরও ছুটি নিয়েছেন তিনি।

সূত্র বলছে, ২৫ বছরের চাকরি জীবনে শাহীন হাসান অন্তত প্রায় ১০ বছর ছুটি কাটিয়েছেন। বেশিরভাগ ছুটিই তিনি নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার উদ্দেশে।

শাহীন হাসান দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও সম্প্রসারণ পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে এখন পর্যন্ত তেমন কোন মৌলিক গবেষণা আলোর মুখ দেখেনি তার দফতর থেকে। অনেকে বলছেন, গবেষণা পরিচালকই যদি দিনের পর দিন ছুটিতে থাকেন তাহলে সেখানে কী আর গবেষণা হবে?

গবেষণা কাজের নামে ডেপুটেশন ও লিয়েন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে তার বিদেশ যাওয়া ও গবেষণা কর্ম নিয়েও নানা আলোচনা ও সমালোচনা রয়েছে ক্যাম্পাসে।

বাংলাদেশ পোস্টের হাতে আসা নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শাহীন হাসান পোস্টডকের জন্য ২ বছর, লিয়েন হিসেবে ৫ বছর এবং প্রায় ৮৫০ দিন অর্জিত ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া গেছেন। বর্তমানে তার কোন অর্জিত ছুটি নেই।

এছাড়া বিনা বেতনে, অর্ধ গড় বেতনসহ নানা নামে তিনি আরও অনেক ছুটি কাটিয়েছেন। এই ছুটিও নিয়েছেন ইচ্ছেমতো। ভাল না লাগলে বাতিলও করেছেন একাধিকবার। এরমধ্যে একবার ২৩ দিনের ছুটি নিয়ে মাত্র ৪ দিন পরই তিনি ছুটি বাতিল করে কাজে যোগ দেন। ২০১০ সালের ১৮ জুলাই থেকে ১৬৭ দিন শ্রান্তি বিনোদন ছুটি নেন তিনি। কিন্তু ১৩৩ দিন ছুটি ভোগ করে আবার কর্মস্থলে যোগ দেন।

দেখা যায়, অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রিচার্স ফেলো হিসেবে গবেষণার জন্য শাহীন হাসানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছুটি মঞ্জুর করে ডুয়েট প্রশাসন। পরবর্তীতে তিনি আবেদন করে ছুটি কার্যকর হওয়ার তারিখ পরিবর্তন করেন। পরে ওই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে তার ২ বছরের ছুটি কার্যকর হয়। অস্ট্রেলিয়ায় ছুটি থাকা অবস্থায় তিনি আরও দু দফায় মোট ছুটি বাড়িয়ে ১১৩৯ দিন ছুটি ভোগ করেন।

২০১৪ সালে ওই ছুটি শেষে দেশে ফিরে প্রায় এক বছর পর সিন্ডিকেট সভায় বিনা বেতনের ছুটিকে বিশেষ বিবেচনায় লিয়েন-এ রুপান্তর করা হয়। প্রভাব খাটিয়ে শাহীন হাসান এটা করেছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন।

২০১৪ সালের ২৭ মে দীর্ঘ ছুটি কাটিয়ে দেশে ফিরে মাত্র দুই মাসের মাথায় তিনি আবার ৮৯ দিন অর্জিত ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যান। ওই ছুটি শেষে সাড়ে ৬ মাস পর আবার ৫১ দিন অর্জিত ছুটি নেন তিনি। ছুটি শেষ হওয়ার পরদিন থেকে আবার ১৫ দিনের ঈদের ছুটি ভোগ করেন।

ওই সময়েও তিনি অস্ট্রেলিয়াতে ছিলেন। মাত্র ২ মাস ৯ দিন অফিস করার পর আবার ৭৩ দিনের জন্য অস্ট্রেলিয়া যান তিনি। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরেরর মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি সেখানে অবস্থান করেন। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ থেকে ২০ জুন পর্যন্ত দু দফায় ডেপুটেশন নিয়ে ৭৮ দিনের জন্য অস্ট্রেলিয়া যান শাহীন হাসান। সাড়ে ৪ মাস পর পহেলা নভেম্বর থেকে এক বছরের জন্য ডেপুটেশন নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যান পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রির জন্য।

সেখানে প্রায় ২ বছর অবস্থান করেন। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ওই ছুটি শেষে আরও দু দফায় ঈদের ছুটি ও ব্যক্তিগত সফরের নামে এক মাসেরও বেশি সময় অস্ট্রেলিয়ায় ছুটি কাটান। ২০১৯ সালে ২৫ দিন বিভিন্ন ছুটি যোগ করে ২৫ দিন অস্ট্রেলিয়া অবস্থান করেন শাহীন।

সর্বশেষ করোনা মহামারির সময়ে ২৯ মার্চ আবারও অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার জন্য উপাচার্যের কাছে ছুটির আবেদন করেন তিনি। কিন্তু   ওই সময় সরকারি কর্মকর্তাদের নিজ কর্মস্থলে উপস্থিত থাকার সরকারি নির্দেশনা থাকায় উপাচার্য তার ছুটি মঞ্জুর করেননি। শাহীন হাসান এসবের তোয়াক্কা না করেই অস্ট্রেলিয়া চলে যান। এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চিঠির প্রেক্ষিতে গত ৯ আগস্ট তিনি দেশে ফেরেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকের অভিযোগ, নিয়ম-কানুনের ব্যাপারে শাহীন হাসান চৌধুরী অন্যের ব্যাপারে কঠোর হলেও নিজের ক্ষেত্রে উদাসীন। হুটহাট করেই তিনি অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছেন। অনেক সময় যাওয়ার আগে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে আরেকজনের উপর হস্তান্তর না করেই ছুটিতে যান। এর ফলে শিক্ষা কার্যক্রম এবং দাপ্তরিক কাজে ব্যাঘাত ঘটে।

শিক্ষকরা বলছেন, নিয়ম অনুযায়ী একজন শিক্ষক ছুটি নিতেই পারেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিও তার দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। অল্প সময়ের ব্যবধানে বারবার ছুটি নিলে কাজে ব্যাঘাত ঘটে। উদাহরণ হিসেবে তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিস্টার ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষকদের নির্দিষ্ট ক্লাস নিতে হয়। কিন্তু কেউ যদি একের পর এক ছুটি নিতে থাকেন, তাহলে তার ওই ক্লাসের জন্য নানারকম সমস্যা সৃষ্টি হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, করোনাকালীন সময়ে ছুটি না নিয়েই বিদেশে যাওয়ার বিষয়টি গর্হিত অপরাধ। অন্য কেউ এমন অনিয়ম করলে তার চাকরি নিয়ে টানাটানি হতো।

এস  এস