ন্যাভিগেশন মেনু

আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারে বাংলাদেশের ইসলামি ব্যাংকিং এবং সুকুকের ভবিষ্যত


বাংলাদেশ, একটি বিস্ময়ের নাম। নানান চড়াই উতরাই দেশটির উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে বার বার বাধাগ্রস্ত করলেও আমরা থেমে থাকি নি, থাকতে পারি নি। ভৌগোলিক কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের নিত্য সঙ্গী, সাথে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে সফরসঙ্গী। তবু কি থেমে আছে আমাদের পথ চলা! আমাদের অর্থনৈতিক বাজারের কথাই ধরুন, যেমন রয়েছে বৈদেশিক রিজার্ভের শক্তি, প্রবাসী সৈনিকদের কষ্টার্জিত আয় থেকে পাঠানো শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ, কিংবা রপ্তানিকৃত সাফল্যমন্ডিত পোশাক খাত, আবার সেই সাথে রয়েছে ব্যাংকিং খাতের বিপুল অংকের শ্রেণিকৃত ঋণের বোঝা কিংবা শেয়ার বাজারের অনাকাঙ্ক্ষিত উত্থান-পতন। আর্থিক বাজারের এমন অস্থিরতার মাঝেই প্রথাগত ব্যাংকিং-এর পাশাপাশি এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করা শরিয়াহনির্ভর ইসলামি ব্যাংকিং, যা ব্যাংকিং খাতের প্রায় ৩০% জায়গা ইতোমধ্যেই দখল করেছে।  

এখন সারা বিশ্বেই ইসলামি ব্যাংকিং ধীরে ধীরে শুধু জনপ্রিয়তাই লাভ করছে না, বরং বিশুদ্ধ মানব-কল্যানমুখী এই ব্যাংকিং ব্যবস্থা কিভাবে আরও বেশি প্রায়োগিক করা যায় তা নিয়ে দেশে-বিদেশে আলোচনা-বৈঠকেরও কমতি নেই। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি মালয়েশিয়া ভিত্তিক সুপরিচিত প্রতিষ্ঠান রেডমানি গ্রুপ ৩য় বারের মত বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং ইসলামী ব্যাংকিং-এর উপর আন্তর্জাতিক ‘আইএফএন অনএয়ার রোডশো ২০২২’ আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে যোগদানকারী বিজ্ঞ প্যানেলিস্টদের মধ্যে দেশি-বিদেশি ইসলামি-ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞগণ উনাদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা এবং দিক নির্দেশনা উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য এবং মডারেটরসহ সকল প্যানেলিষ্টদের পরিচয় করিয়ে দেন রেডমানি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনড্র্যু টিব্বত। আন্তর্জাতিক এই ওয়েবিনারটিতে মডারেটর হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শরিয়াহভিত্তিক স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব মোঃ তৌহিদুল আলম খান।

অনলাইনে আয়োজিত এই গোল-টেবিল বৈঠকে আলোচিত বিষয়গুলো এতটাই সময়োপযোগী এবং বস্তুনিষ্ঠ ছিল যে নীতি-নির্ধারকগণ ভবিষ্যত পরিকল্পনা প্রনয়ণেরর জন্য এখান থেকেই চিন্তার বহুবিধ খোরাক পেয়ে যাবেন। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ইসলামি ব্যাংকিং এবং সুকুকের (ইসলামিক বন্ড) সম্ভাব্য ভূমিকা ও কার্যকারিতা অনুষ্ঠানের মূল প্রতিপাদ্য হলেও বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপ্রবাহকে টেকশই ও সমুন্নত রাখতে প্রয়োজনীয় এমন কোন বিষয় নেই যা উক্ত অনুষ্ঠানে আলোচিত হয়নি। জলবায়ু পরিবর্বন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা তৈরিতে অর্থনৈতিক প্রস্তুতি, সরকারি এবং বেসরকারি বন্ড বাজারের উন্নয়ন, টেকশই অর্থনীতি নিশ্চিতকরণে ইসলামি অর্থায়নের ভূমিকা, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতকল্পে সহায়ক চালিকাশক্তি এবং টেকনোলজির ব্যবহার, ট্যাক্স কাঠামোর পরিবর্তন প্রসঙ্গসহ জরুরি কোন কিছুই এই আলোচনা থেকে বাদ যায় নি। এমনকি আর্থসামাজিক উন্নয়নে ইসলামী সুকুকের বহুবিধ ব্যবহার নিশ্চিত করতে দেশের শক্তিশালী এনজিওগুলোর সম্ভাব্য ভূমিকার কথাও আলোচনায় উঠে আসে।

মূল পর্বের শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সম্মানিত কমিশনার ড. মিজানুর রহমান। তিনি গত তিন দশকে বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের উন্নয়নের একটি তথ্যচিত্র উপস্থাপনের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগসম্পর্কিত ঝুঁকির বিষয়ে আলোকপাত করেন। বাংলাদেশ যেখানে ক্রমাগত একটি উৎপাদনশীল দেশে পরিনত হচ্ছে, সেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে প্রায়শই পন্য ও কাঁচামালের সাপ্লাই-চেইন বা সরবরাহ প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে অপারগ হয়ে যায়। এ ধরণের সংকট মোকাবিলায় তিনি পর্যাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ এবং প্রতিশ্রুতিশীল উদ্ভাবনীর দিকে জোড় দেয়ার ব্যপারে গুরুত্ব প্রদান করেন।                          

মূল পর্বের আলোচনা প্রানবন্ত এবং উপভোগ্য হয়ে ওঠে জনাব মোঃ তৌহিদুল আলম খানের দক্ষ সঞ্চালনা এবং বিজ্ঞ প্যানেলিস্টগণের বস্তুনিষ্ঠ এবং যৌক্তিক উপস্থাপনার মাধ্যমে। ইসলামিং ব্যাংকিং-এর ব্যাপ্তি প্রসঙ্গে জনাব মোঃ তৌহিদুল আলম খান বলেন, বর্তমানে (৩১ মার্চ, ২০২২ তথ্য অনুযায়ী)বাংলাদেশে ১০টি পূর্ণ পরিধির বেসরকারী বানিজ্যিক ইসলামী ব্যাংক, ৯টি প্রচলিত বানিজ্যিক ব্যাংকের ৪১টি ইসলামী ব্যাংকিং ব্রাঞ্চ এবং ১৩টি বানিজ্যিক ব্যাংকের ৪৩৮টি ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডো রয়েছে। প্রায় ৯০% মুসলিম অধিবাসীর ধর্মীয় মূল্যবোধ, অপেক্ষাকৃত কম এসএলআর এবং অধিক বিনিয়োগ-আমানত অনুপাত থাকায় ইসলামি ব্যাংকিং বাংলাদেশে যেমন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে তেমনি সম্ভাবনার নতুন দ্বারও উন্মোচন করছে।

তারল্য ব্যবস্থাপনা, বাজেট-ঘাটতি পূরণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে অর্থায়নের টেকসই বিকল্প হিসেবে ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রথম ইসলামিক সুকুক ইস্যু করা হয়। এতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ইসলামি ব্যাংক ও ইসলামি আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অবদানের ক্ষেত্র ও পরিধি দুটোই বৃদ্ধি পায়। ইসলামিক ব্যাংকিং এবং সুকুক কিভাবে আরও বেশি কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের উত্তরে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক গ্রুপ বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার জনাব হাসান মোহাম্মদ নাঈম রহমান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ইস্যুকৃত সরকারি সুকুকে চাহিদার তুলনায় অকশনে দাখিলকৃত বিডের পরিমাণ প্রায় চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি হওয়া প্রমাণ করে যে ইসলামী শরিয়াহ-ভিত্তিক বিনিয়োগ সার্টিফিকেট সুকুকের বিপুল জনপ্রিয়তা এ দেশে রয়েছে। তাই ইসলামী সুকুক পরিচালনায় সুস্পষ্ট বিধিমালা একান্ত আবশ্যক। সাধারনত ইজারা পদ্ধতিতে সুকুকের ব্যবহার দেখা যায়, মুদারাবা বা মুশারাকা পদ্ধতিতে সুকুক অর্থায়ন কার্যকর করা যেতে পারে। সম্ভাবনাময় সুকুকের ভবিষ্যত অবস্থানকে সুদৃঢ় এবং কার্যকরী করতে হলে এই খাতে দক্ষ লোকবল তৈরি করা অপরিহার্য। ইসলামী সুকুকে ইসলামী ব্যাংকগুলো স্বাভাবিকভাবেই বেশি আগ্রহী হবে যেহেতু তারা উদ্বৃত্ত অর্থ বিনিয়োগের জন্য শরীয়াহভিত্তিক হাতিয়ার পাচ্ছে, যা এখন অপ্রতুল। তিনি আরও মনে করেন, শরীয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকগুলোর প্রকৃত শরীয়াহ নীতিমালা পরিপালনের জন্য শরীয়াহ বোর্ডের স্কলারদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা, দক্ষতা এবং স্বাধীনতা থাকা উচিত। সেক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঠিক নীতিমালা থাকা দরকার।

অন্যতম প্যানেলিস্ট, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ওরলিন্স ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. কবির হাসান ‘সুকুক’ বিষয়ে নতুন মাত্রা যোগ করেন। তিনি মনে করেন, সুকুক এর প্রয়োগ ও ভবিষ্যত কার্যকারিতা নির্ভর করবে একটি সুষম বন্ড বাজারের উপর। বাংলাদেশের বন্ড বাজার এখনও সেভাবে গড়ে ওঠে নি। এমন কি দক্ষিন এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের এই আর্থিক বাজারের অবস্থা নাজুক। তাই ‘সুকুক’ জনপ্রিয় করতে হলে আগে বন্ড বাজারকে শক্তিশালী রুপ দিতে হবে এবং জনমনে এ ব্যপারে পরিষ্কার ধারণা সৃষ্টি করতে হবে। দেশে এখন পর্যন্ত যে কয়টি সুকুক ইস্যু করা হয়েছে তাতে সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয় যে সরকারি বন্ডে চার-পাঁচগুন বেশি সাবক্রিপশন জমা পড়লেও বেসরকারি খাতের বেক্সিমকো সুকুকে সেভাবে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ দেখা যায় নি। এতে এটাও প্রমানিত হয় যে বেসরকারি উদ্যোগে ইস্যুকৃত সুকুকের উপর মানুষের সেভাবে আস্থা তৈরি হয় নি। বেসরকারি সুকুক বাস্তবায়নের পূর্বে একটি  আদর্শ বন্ড বাজার সৃষ্টি করা বেশি জরুরি, তাহলে অর্থনৈতিক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিকল্প হাতিয়ার হিসেবে সুকুক পূর্ণ সফলতা অর্জন করতে সমর্থ হবে। ড. কবির হাসান আরও মনে করেন, বানিজ্যিক ব্যাংকগুলো যাতে দীর্ঘ মেয়াদী অর্থায়ন না করতে পারে সে লক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা প্রনয়ন করা উচিত। তখন দীর্ঘ মেয়াদী অর্থায়নের চাহিদা পূরণের উৎস হতে পারে বেসরকারি খাত, হাতিয়ার হবে বন্ড কিংবা ইসলামী সুকুকের মত আর্থিক হাতিয়ার, আর শক্তিশালী হবে এদেশের বন্ড বাজার।

প্রকৃতপক্ষে, দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার যে অনবদ্য সক্ষমতা ইসলামী সুকুকের রয়েছে, এখনও তার অনেকটাই অনাবিষ্কৃত। এমনটাই ধারণা পাওয়া গেল বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেইনিং একাডেমির ফ্যাকাল্টি, জেনারেল ম্যানেজার ড. গুলজারে নবীর কাছ থেকে। অন্য প্যানেলিস্টদের মত তিনিও মনে করেন যে অবকাঠামোগত উন্নয়নে সরকারের যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন, ইসলামী ব্যাংকগুলোর অতিরেক অর্থ সেখানে সুকুক অর্থায়নের মাধ্যমে কার্যকর করা সম্ভব। সরকারের পাঁচ বছরের জাতীয় নীতিমালায় ইসলামী সুকুক অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। নীতি নির্ধারকদের কাছেও সুকুক কিছুটা অপ্রচলিতই থেকে গেছে এখন পর্যন্ত, যেকারণে মানিটারী পলিসিতে শুধু সুদভিত্তিক ঋণ গুরুত্ব পাচ্ছে। জনাব গুলজারে নবী ইসলামী সুকুকের সামাজিক কর্মে ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে আমাদের দেশে পরিচালিত বিশ্বমানের এনজিওগুলোকে  কিভাবে এই খাতে ব্যবহার করা যায় সেবিষয়েও কিছু প্রস্তাবনা উপস্থাপন করে নতুনত্ব যোগ করেন। শুধু তাই নয়, আমাদের দেশের বানিজ্যনির্ভর অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি পোশাক শিল্প, কিংবা মৌসুমী খাদ্য আমদানি করার ক্ষেত্রেও স্বল্পমেয়াদী সুকুক প্রবর্তন ফলপ্রসু ভূমিকা রাখতে পারে বলেও তিনি আশা ব্যক্ত করেন। পোশাক শিল্প  ছাড়াও আয় সৃষ্টিকারী অন্যান্য খাত যেমন চামড়া, স্টীল, ঔষধ শিল্প বা বেসরকারি হাসপাতাল খাতে সুকুক পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করার পরামর্শ দেন তিনি। এতে করে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে দেশের ট্যাক্স কাঠামো। বিশেষ করে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে ট্যাক্স এবং অর্থনৈতিক হাতিয়ার সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগ নীতিমালা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাই দেশীয় বিনিয়োগকারীদের সাথে সাথে যেন বিদেশী বিনিয়োগকারীদেরও ইসলামী সুকুক অর্থায়নের দিকে আকৃষ্ট করা যায় সে লক্ষে উপযুক্ত এবং সহনীয় ট্যাক্স কাঠামো প্রনয়ন জরুরি বলে মনে করেন রেডমানি কনসাল্টিং এর সিইও ড.  নাটালি স্কুন। সেই সাথে ড. কবির হাসান মনে করেন, বাংলাদেশে ইসলামিক ব্যাংকিং আইন এবং ইসলামী বন্ড বাজার পরিপালনের সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা আবশ্যক, যা কিনা এই খাতের একটি বড় ঘাটতি।

উর্ধ্বমুখী মুদ্রাস্ফীতিকে দীর্ঘমেয়াদী সুকুক প্রবর্তন এবং তার কার্যকারিতার ক্ষেত্রে অন্যমত বাধা হিসেবে দেখছেন অন্য প্যানেলিস্ট এবং সুকুকভিত্তিক আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ‘আল ওয়াসিলা’র প্রতিষ্ঠাতা ড. স্কট লেভি। ইসলামিক ব্যাংকিং অর্থায়ন দেশের টেকশই অর্থনীতি গড়ে তুলতে বিকল্প অর্থায়ন ব্যবস্থা হিসেবে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে কিনা, জনাব তৌহিদুল আলম খানের এমন প্রশ্নে ড. স্কট লেভি মনে করেন তা সম্ভব, তবে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দেন মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রনে সুকুক কিভাবে ব্যবহার করা যায় তার উপর। কারণ সুকুক-অর্থায়ন সাধারণত হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে। সেক্ষেত্রে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি বিনিয়োগকারীদের আশানুরুপ মুনাফা অর্জন ব্যহত করতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতির বিবেচনায় অন্ততপক্ষে আগামী ৬-১২ মাস দীর্ঘমেয়াদী সুকুক ইস্যু না করে স্বল্পমেয়াদী অর্থায়নের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বানিজ্যনির্ভর বাংলাদেশের এই অর্থনীতিতে ইসলামিত ব্যাংকিং খুব সহজেই মানানসই। মুশারাকা পদ্ধতিতে স্বল্পমেয়াদী অর্থায়ন মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

ইসলামী সুকুক কিভাবে আরও বেশি আকর্ষনীয় করা যায় এমন প্রশ্নের জবাবে মুডি’স ইনভেস্টরস সার্ভিসের কর্তকর্তা শার্লি  জেং বলেন, সুকুক প্রবর্তনের ক্ষেত্রে ইএসজি (Environmental, Social & Governance) নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত করা হলে বিনিয়োগকারীদের কাছে সুকুক আরও বেশি গ্রহনযোগ্যতা পাবে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট দূরীকরণে প্রচলিত ধারার ব্যাংকিং-এর সাথে বা বিকল্প হিসেবে ইসলামী ব্যাংকিং এবং ইসলামী বন্ডের বহুধা ব্যবহারের কথা আলোচনা হবে আর সেখানে বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক উন্নতির অন্যতম চালিকাশক্তি ‘টেকনোলজি’ প্রসঙ্গে আলোচনা হবে না, তা কিভাবে হয়? সেদিক থেকেও এই জ্ঞানগর্ভ বৈঠকটি দর্শকদের বঞ্চিত করে নি। ইসলামী ব্যাংকিং খাতে শরীয়াহ ভিত্তিক ক্রেডিট কার্ড বা রিটেইল পন্যগুলো কেমন প্রভাব বিস্তার করছে এবং ইসলামী ব্যাংকিং অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরণে কেমন ভূমিকা রাখতে পারে, জনাব মোঃ তৌহিদুল আলম খানের এমন প্রশ্নে সাদিক, সিপিবিবি, এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের ডিরেক্টর আসিফ রহমান বলেন, প্রচলিত বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে ইসলামী ব্যাংকগুলো ইতোমধ্যেই শরীয়াহভিত্তিক ক্রেডিট কার্ড এবং পন্য বাজারে এনেছে এবং টেকনোলজির ব্যবহারেও তারা পিছিয়ে নেই। অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরণে ব্যাংকগুলো যত বেশি টেকনোলজির ব্যবহার নিশ্চিত করবে তখন বেশি সফল হবে। টেকনোলজি ভিত্তিক অবকাঠামো যত শক্তিশালী করতে পারবে, ইসলামী ব্যাংকগুলোও এক্ষেত্রে তত বেশি সফলতা বয়ে আনবে।              

মূল পর্বের আলোচনা শেষে প্রশ্ন-উত্তর সেশনে আলোচকবৃন্দ আরও কিছু গুরুত্বপুর্ণ বিষয় তুলে ধরেন, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, যাকাত ফান্ডের সুষ্ঠু ব্যবহার। ইসলামী ব্যাংকিং এর সুবাদে যদি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে যাকাত ফান্ড কাজে লাগানো যায় সেটা একটা যুগান্তকারী উদ্যোগ হতে পারে। ড.  কবির হাসান বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে প্রচলিত রাজস্ব আয়ের ৩৫%, জাতীয় বাজেটের ২১% সামগ্রিক যাকাত তহবিলের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আহরণ করা সম্ভব, যা কিনা জিডিপির ৪%। ড. গুলজারে নবী বাংলাদেশ ব্যাংক এর কর্মপরিকল্পনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন, যেখানে প্রান্তিক এবং ব্যাংক-খাত বহির্ভুত জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং-কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত করার জন্য উদ্যোগের কথা বলেন, যেমনঃ ‘নো-ফ্রিল’ একাউন্টধারীদের জন্য ২,০০০ কোটি টাকার রিফাইন্যান্স স্কিমের সুবিধা। সত্যিকার অর্থে,  ইসলামী ব্যাংকিং টেকশই অর্থায়ন ধারণার সাথে পুরোপুরি সাযুজ্যপূর্ণ, কারণ এই পদ্ধতিতে ক্ষতিকর কোন খাতে অর্থায়ন করার সুযোগ নেই। দেশের আপামর জনসাধারণের জন্য হিতকর এই খাত শুধু বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্যই নয় বরং ধর্ম-বর্ণ, ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকলের জন্যই কল্যানকর।

সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রানবন্ত আয়োজনটি শেষ করার পুর্বে সঞ্চালক জনাব মোঃ তৌহিদুল আলম খান বলেন, সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী ইসলামী ব্যাংকগুলো দেশের কৃষি খাতের মোট বিনিয়োগের ২৭% অর্থায়ন করে। রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে প্রায় ৩১%। আর সিএসআর বা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে তাদের ব্যয় ০.৮৯ বিলিয়ন টাকা। জনহিতকর এই ইসলামী ব্যাংকিং খাত আরও এগিয়ে যাবে এটাই সবার কাম্য, প্রয়োজন শুধু সঠিকভাবে শরীয়াহ পরিপালন করে তার ব্যবহার নিশ্চিত করা।    


মোঃ মুকিব-উল আহসান

রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট, সাসটেইন্যাবল  ফাইন্যান্স, ইনভেস্টমেন্ট ডিভিশন

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড