ন্যাভিগেশন মেনু

ওয়াং ই’র বাংলাদেশ সফর: সংক্ষিপ্ত হলেও ফলপ্রসু ও তাৎপর্যপূর্ণ


শনি, রবি দু’দিন মিলিয়ে বাংলাদেশে ১৭ ঘন্টার সংক্ষিপ্ত সফর করে গেলেন চীনের রাষ্ট্রীয় কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। তাঁর সফরটি খুবই সংক্ষিপ্ত হলেও সার্বিক বিবেচনায় অত্যন্ত ফলপ্রসু ও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। 

সরকারি সফরে শনিবার বিকালে ঢাকা এসে পৌঁছালো পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের অনুপস্থিতিতে বিমান বন্দরে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে যথাযথ সম্মানে স্বাগত জানান বাংলাদেশের কৃষিমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা আব্দুর রাজ্জাক। এ সময় বিমান বন্দরে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন ও ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। 

সফরের প্রথম দিনে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানান ওয়াং ই। তিনি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন। সেখানে তাকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। একইদিন ওয়াং ই’র সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। 

সফরের দ্বিতীয় দিনে রোববার সকালে হোটেল সোনারগাঁওয়ে প্রাতঃরাশ সভায় মিলিত হন দু’দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বৈঠকে দু’দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়সহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়। বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্য-বিনিয়োগ, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা সহযোগিতা, রোহিঙ্গা ও তাইওয়ান ইস্যু সবই আসে আলোচনায়। বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে একটি চুক্তি ও তিনটি সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষরিত হয়। 

এগুলো হচ্ছে পিরোজপুরে কচা নদীর ওপর নির্মিত অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু হস্তান্তর, দুর্যোগ মোকাবেলায় পাঁচ বছর মেয়াদি সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চীনের ফার্স্ট ইনস্টিটিউট অব ওশেনোগ্রাফির মধ্যে সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয়ে সহযোগিতা। 

দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের পর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানান, আনুষ্ঠানিক চুক্তি ও সমঝোতাস্মারক সইয়ের বাইরে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা ও প্রস্তাব দিয়েছেন বাংলাদেশকে।

ওয়াং ই চীনের বাজারে আরও এক শতাংশ বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের ঘোষণা দেন। বাংলাদেশ আগেই ৯৭ শতাংশ পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা পেয়ে আসছিল। নতুন এক শতাংশ যুক্ত হওয়ায় এখন বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ পণ্য চীনের বাজারে শুল্ক ছাড়াই ঢুকতে পারবে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী একে ওয়াং ই’র বাংলাদেশ সফরের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসেবে অভিহিত করেন। 

সত্যিকার অর্থেই এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় প্রাপ্তি। বাংলাদেশের অন্যতম ব্যবসায়িক ও উন্নয়ন অংশীদার চীন। তবে দু’দেশের বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা রয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীন থেকে ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। বিপরীতে চীনে রপ্তানি করেছে মাত্র ৬০ কোটি ডলারের পণ্য।

এ অবস্থায় আরও এক শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ায় বাংলাদেশের গার্মেন্টস, ওষুধ ও আইটি পণ্য রপ্তানি বাড়বে চীনে। এর ফলে দু’দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা হলেও কমবে। 

এ ছাড়া বৈঠকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী দু’দেশের মধ্যে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি-পিটিএ স্বাক্ষরের যৌথ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রস্তাব দেন। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব-পিপিএ বিষয়ে নতুন সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষরের  বিষয়েও প্রস্তাব দেয় চীন। বাংলাদেশ এ সব প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। 

অন্যদিকে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বাড়াতে ওয়াং ই’র প্রতি আহ্বান জানান ড. মোমেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিশেষ করে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চীনের অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ, অধিক পরিমাণে চীনা কারখানা স্থাপন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের আহ্বান জানান তিনি।

জবাবে ওয়াং ই দ্রুত চীনের অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু করা তাগিদ দেন। ঢাকা-কুনমিং ও ঢাকা-কুয়াংচৌ সরাসরি বিমান যোগাযোগ চালু হলে তা দু’দেশের মানুষের মধ্যে সংযোগ স্থাপন ও অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন তিনি।

বৈঠকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা আসে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে। করোনা মহামারির কারণে দু’বছরের বেশি সময় ধরে চীনে যেতে পারছে না বাংলাদেশের শত শত শিক্ষার্থী। এ অবস্থায় তাদের শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। এ কারণে চীনে অধ্যয়নে গমনেচ্ছু শিক্ষার্থীদের সোমবার থেকে ভিসা ও ট্রাভেল পারমিট দিতে ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসকে নির্দেশনা দেন ওয়াং ই। 

মোমেন-ওয়াং বৈঠকে অনিবার্যভাবেই এসেছে রোহিঙ্গা ইস্যুটি। মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও ১১ লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও তারা হুমকি তৈরি করছে। 

এ প্রসঙ্গে বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনের বক্তব্য উদ্ধৃত করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানান, রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে চীন অনেকদূর এগিয়েছিল। এখন একটা ‘কনক্লুশন’ দরকার। জবাবে ওয়াং ই জানান চীন রাখাইনে তিন হাজার বাড়ি তৈরি করে দিয়েছে। আর প্রত্যাবাসনের পর রোহিঙ্গাদের খাদ্যের ব্যবস্থা করবে বেইজিং। রোহিঙ্গা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে চীন কাজ করে যাবে বলে ওয়াং ই বৈঠকে আশ্বস্ত করেন। 

বৈঠকে তাইওয়ান পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়। একচীন নীতির প্রতি বাংলাদেশ তার দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছে। তাইওয়ান ইস্যুতে সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানান চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। 

রোববার সকালে ঢাকা ত্যাগের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ওয়াং ই। এ সময় একচীন নীতির প্রতি বাংলাদেশের দৃঢ় সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন শেখ হাসিনা। তবে, ধৈর্য্য ও সংযমের সঙ্গে তাইওয়ান সংকট মোকাবেলার পরামর্শ দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। 

ওয়াং ই একচীন নীতির প্রতি অব্যাহত সমর্থনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কৃতজ্ঞতা জানান। বাংলাদেশের ভিশন-২০৪১, সোনার বাংলা গড়ার প্রচেষ্টায় চীন সহযোগী হিসেবে কাছে থাকবে বলে শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেন ওয়াং ই।

রোববার দুপুরে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ওয়াং ই’র সফরের বিস্তারিত তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন। বলেন, তার এ সফর বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। একই দিন ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসের ফেসবুক পেজে জানানো হয়, বৈঠকে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী দু’দেশের কৌশলগত সহযোগিতার বিষয়ে অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।

সার্বিক বিবেচনায় দেখা যায়, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরটি খুবই সংক্ষিপ্ত হলেও দু’দেশের বাণিজ্য-বিনিয়োগ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রোহিঙ্গা ও তাইওয়ান ইস্যুসহ সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সবগুলো ক্ষেত্রেই ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমও তাঁর সফর সবিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। তাই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র সফরটিকে অত্যন্ত ফলপ্রসু ও তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবেই দেখছে সংশ্লিষ্ট মহল। 

- মাহমুদ হাশিম, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, চীন আন্তর্জাতিক বেতার