ন্যাভিগেশন মেনু

''ভাইরাল জান্নাত''-এর স্কুলের পরিচয় নিয়ে 'সংযোগ বাংলাদেশ'-এর প্রধান নির্বাহী সাদিয়া নাসরিনের মিথ্যাচার

বাংলাদেশ পোস্ট-এর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এলো চমকপ্রদ তথ্য


মহাখালী আব্দুল হামিদ দর্জি  সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কে নিজের প্রতিষ্ঠিত স্কুলের শিক্ষার্থী দেখিয়ে মিথ্যাচার করছে ‘সংযোগ বাংলাদেশ’এর প্রধান নির্বাহী সাদিয়া নাসরিন।

গত ২৪ মার্চ মহাখালী এলাকার গোডাউন বস্তিতে আগুন লেগে পুড়ে যাওয়ার পর জান্নাতুল ফেরদৌস (জান্নাত) নামের একটি ছোট মেয়ের ভিডিও গণমাধ্যামে ভাইরাল হয়। সে ওই ভিডিওতে বলে ''সবকিছু পুইরা যাক, আমার মা তো বাইচা আছে, এইডাই বেশী, আর লাগবো না।'' এই ভিডিও সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে সে ''ভাইরাল জান্নাত নামে পরিচিতি পায়।

এই ঘটনার পরবর্তীতে চ্যানেল আই-এর এক টকশোতে তাকে 'আলোর পথে' স্কুলের ছাত্রী হিসেবে পরিচয় করানো হয়। সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করছেন যে, এটি সুকৌশলে করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে জান্নাত মহাখালী আব্দুল হামিদ দর্জি  সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির নিয়মিত ছাত্রী, জান্নাতের ক্লাস রোল ০২ ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সে একই স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়। দ্বিতীয় শ্রেণিতে জান্নাতের ক্লাস রোল ৩১ । প্রথম শ্রেণি থেকে সে এই স্কুলের ছাত্রী।

মহাখালী আব্দুল হামিদ দর্জি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস-এর নামে নামে তৃতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার সনদপত্র ।

চ্যানেল আইসহ অন্যান্য বেশ কিছু গণমাধ্যমে জান্নাতকে দেখানো হয়েছে সে 'আলোর পথে কমিউনিটি স্কুল' নামক একটি বেসরকারী এনজিও পরিচালিত স্কুলের ছাত্রী, যা পুরোটাই মিথ্যা।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জান্নাতের মা শিল্পী বেগম প্রতিবেদকে জানান যে, জান্নাত মহাখালী আব্দুল হামিদ দর্জি  সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এর নিয়মিত ছাত্রী। এখানে সে তিন বছর যাবৎ পড়াশোনা করছে। তবে তিনি স্বীকার করেন যে, 'আলোর পথে' স্কুলে সে একসময় সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করত।

প্রমান হিসেবে তিনি প্রতিবেদকে মহাখালি আব্দুল হামিদ দর্জি  সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এর রেজাল্ট কার্ড এবং স্কুল ড্রেস দেখান। রেজাল্ট কার্ডে জান্নাতের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে, এবং ক্লাস রোল ০২।

জান্নাতের সাথে একই স্কুলে পড়ে, তার বাড়ির পাশের আরেকজন ছাত্রীর নামও জান্নাত (৫ম শ্রেণি, ক্লাস রোল ১৭), সে জানায় ''আমি ও ভাইরাল জান্নাত মহাখালি আব্দুল হামিদ দর্জি  সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ি। আমরা একই সাথে স্কুলে যাই।'' জান্নাতের সাথে পড়ুয়া আরো কয়েকজন সহপাঠীর সাথে প্রতিবেদকের কথা হয়, তাদের বক্তব্যও একই।

মহাখালীর গোডাউন বস্তির ভিতরে ব্র্যাক স্কুল ও কিশোরী সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়, বর্তমানে যেগুলো আগুনে পুড়ে গেছে। এ সকল প্রতিষ্ঠান শিশুদের সহশিক্ষা নিয়ে কাজ করে। তবে এলাকাবাসী জানায়, সংযোগ বাংলাদেশ-এর অধীনে পরিচালিত 'আলোর পথে' স্কুল বস্তির বাহিরে কার্যক্রম পরিচালনা করে।

এদিকে মহাখালী আব্দুল হামিদ দর্জি  সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১০ রমজান থেকে বন্ধ রয়েছে। স্কুল খুলবে ইদের পর ২১ এপ্রিল।

মহাখালী আব্দুল হামিদ দর্জি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস-এর নামে নামে তৃতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার সনদপত্র।

অভিযুক্ত সংযোগ বাংলাদেশ-এর প্রধান সাদিয়া নাসরিনের এর সাথে পরিচয় কিভাবে জানতে চাওয়া হলে জান্নাতের মা বলেন, “আগুন লাগার পর জান্নাত ভাইরাল হলে ম্যাডাম (সাদিয়া নাসরিন) আমাদের এখানে আসেন এবং বলেন যে তোমাদের টিভিতে নিয়ে যাব। এরপর আমরা চ্যানেল আই টিভিতে যাই। ম্যাডাম এর কাছ থেকে আমরা কোন আর্থিক সাহায্য পাইনি। তবে অনেকে বলতেছে শুনতেছি টিভি চ্যানেলে আমাদেরকে দেখানোর পর সরকার নাকি আমগো বাড়ি দিছে, লক্ষ লক্ষ টাকা দিছে কিন্তু আমরা কিছুই পাই নাই”।

চ্যানেন আই-এর সেদিনের সে প্রোগ্রামে উপস্থিত ছিলেন জান্নাত এবং সংযোগ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী সাদিয়া নাসরিন, সঞ্চালনায় ছিলেন উপস্থাপিকা সোমা ইসলাম। অনলাইনে যুক্ত ছিলেন এস্তোনিয়া বিশ্ববিদ্যালিয়ের শিক্ষক ড. আমিনুল ইসলাম। সে অনুষ্ঠানে জান্নাত কে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় আলোর পথে স্কুলের ছাত্রী হিসেবে, টিভি স্ক্রলে জান্নাতের স্কুল আলোর পথ দেখানো হয়, যা সুপরিকল্পিত হিসেবে অভিযোগ করছেন এলাকাবাসী। সে অনুষ্ঠানটি আজকের প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত  কয়েক লক্ষ বার ভিউ হয়।

এই ঘটনায় হতবাক মহাখালি আব্দুল হামিদ দর্জি  সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা তহমিনা বেগম। তিনি বলেন, ”জান্নাত আমার স্কুলের নিয়মিত ছাত্রী, অথচ অন্য একটি প্রতিষ্ঠান তার ক্রেডিট নেওয়ার মিথ্যা গল্প বলে বেড়াচ্ছে। জান্নাত আমার স্কুলে তিন বছর যাবৎপড়ছে, সে খুবই মেধাবী ছাত্রী, নিয়মিত স্কুলে আসে। আমরা সাদিয়া নাসরিনের বিষয়টি জানতে পেরেছি। যেহেতু, স্কুল বন্ধ তাই আপতত বিষয়টি নিয়ে স্কুলে গ্রুপ মিটিং এ সাধারণ আলোচনা হয়েছে। ইদের পর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে আমরা কাজ শুরু করব”।

এখন সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলছেন, সাদিয়া নাসরিন আসলে কি চাইছেন? মহাখালী দর্জি সরকারি বিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্রীকে নিজের প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী বলে কেন প্রচার করছেন? জান্নাতের গল্পটিকে পুঁজি করে কি কোন সুযোগ/সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা? 

এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে সাদিয়া নাসরিনের ফোনে কয়েক বার কল ও এসএমএস দিয়েও কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।

আলোর পথে'-এর পক্ষ থেকে একজন শিক্ষক এই প্রতিবেদকের নম্বর সংগ্রহ করে ফোন করেন। তিনি তার নাম প্রকাশ করতে রাজী হন নি। তিনি বলেন, আলোচিত জান্নাতুল ফেরদৌস 'আলোর পথে' স্কুলেরই ছাত্রী।  তখন তাকে প্রশ্ন করা হয় যে, সে তো মহাখালি আব্দুল হামিদ দর্জি  সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং তার নামে তৃতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার সনদপত্র রয়েছে, উত্তরে তিনি বলেন যে পরিবারের পক্ষ থেকে মিথ্যা কথা বলা হয়েছে এবং এরকম সনদপত্র 'আমিও বানাইতে পারি।' ওই ছাত্রীকে আমরা ছোটবেলা থেকেই চিনি, এবং এ বিষয়ে আমরা কোনো মিথ্যা কথা বলছি না।

সাদিয়া নাসরিনের এহেন কর্মকান্ডে কথা হয় প্রাথমিক জেলা শিক্ষা অফিসার জনাব আব্দুল আজিজের সাথে। তিনি বাংলাদেশ পোস্ট-কে বলেন যে তিনি জানতেন না বিষয়টি। খুব দ্রুত বিষয়টি নিয়ে তিনি কাজ করবেন। প্রতারনার আশ্রয় নিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর এক কর্মকর্তার সাথে এই প্রতিবেদকের কথা হয় এবং তাকে যথোপযুক্ত তথ্য ও প্রমান পাঠানো হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন যে মন্ত্রীকে এবিষয়ে অবহিত করা হয়েছে।