ন্যাভিগেশন মেনু

৯ ডিসেম্বর

বাংলাদেশের বিজয় দ্বারপ্রান্তে


১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের বিজয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র এটা বুঝতে পেরেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মরিয়া হয়ে যায়। বিশ্ববাসীও বুঝে গিয়েছে- বাংলাদেশের বিজয় অনিবার্য। এ অবস্থায় পাকিস্তানি শাসকরা তাদের বন্ধুরাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যানের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করে স্বাধীনতা ঠেকাতে চেষ্টা অব্যাহত রাখে।

একই সঙ্গে বাঙালী জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করতেও গোপন ষড়যন্ত্র লিপ্ত হয় তারা। মিত্র ও মুক্তিবাহিনী বীরদর্পে দেশের অধিকাংশ জেলায় বিজয় কেতন উড়িয়ে ঢাকা দখলের জন্য মরিয়া। রণাঙ্গনে চতুর্দিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে পাকবাহিনী। একদিন আগেই বেতারসহ বিমানে হাজার হাজার লিফলেট ছড়িয়ে পাক হানাদারদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায় মিত্রবাহিনী। মিত্রবাহিনী দ্রুত ঢাকা পৌঁছার লক্ষ্য নিয়ে চারদিক থেকে অগ্রসর হচ্ছে।

মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, আমরা এখন বড় ধরনের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। অরোরা জানালেন-নদী যদিও বড় বাঁধা, কিন্তু সে বাঁধা অতিক্রমের সব ব্যবস্থা আমরা করে ফেলেছি। আমাদের পদাতিক সৈন্য ও রসদ পারাপারের ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে।

আর আমাদের পিটি-৬৭ জলচর ট্যাঙ্কগুলো নদী পেরিয়ে যেতে পারবে। মিত্রবাহিনী দ্রুত ঢাকা পৌঁছাবার লক্ষ্য নিয়ে চারদিক থেকে অগ্রসর হচ্ছে। পূর্বে একটি বাহিনী যাচ্ছে আশুগঞ্জ, দাউদকান্দি এবং চাঁদপুর। পশ্চিমে আর একটি বাহিনী পৌঁছেছে মধুমতি নদীর তীরে। আর একটি বাহিনী কুষ্টিয়া মুক্ত করে গোয়ালন্দ ঘাটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। হালুয়াঘাট থেকে এগিয়ে আসা বাহিনীও পৌঁছে গেছে ময়মনসিংহের কাছাকাছি।

মিত্রবাহিনীর বিমান ইউনিট টাঙ্গাইলের নিকটবর্তী কোন এক এলাকায় ৭শ’ ছত্রীসেনা এবং ৮০ টন সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে।

জাতিসংঘ অধিবেশনে প্রতিনিধিত্বকারী পাকিস্তানী দলের নেতা মাহমুদ আলী দেশে ফিরে সাংবাদিকদের কাছে সোভিয়েত ভূমিকার সমালোচনা করে বলেন, সোভিয়েতের উচিত বিশ্ব শান্তির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে ভারতের পাশ থেকে সরে দাঁড়ানো।

চীন ও আমেরিকার সমর্থনের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, পাকিস্তান তাদের নির্ভীক ও ঐতিহাসিক সমর্থনের জন্য অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। এইদিন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভা ও আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয় কংগ্রেসের সমন্বয়ে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভারত ও ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের পর উপদেষ্টা পরিষদের এটিই ছিল প্রথম বৈঠক। বৈঠকে মুক্ত এলাকায় বেসামরিক প্রশাসনের কার্যক্রম শুরু এবং খাদ্য, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।

বিকেলে ভারতীয় বিমানবাহিনী জামালপুরে হানাদার ঘাঁটির ওপর এক ঘণ্টা ধরে কয়েক হাজার পাউন্ডের বোমা নিক্ষেপ করে। এর ফলে পাকসেনারা পালাতে আরম্ভ করে। জামালপুর থেকে পালিয়ে যাবার সময় ভারত-বাংলা যৌথ বাহিনীর কাছে ৬শ’ হানাদার সেনা ধরা পড়ে।

ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ বাংলাদেশে পাকিস্তানী সৈন্যদের উদ্দেশ করে বলেন, ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তোমরা যদি বাঁচতে চাও ভারতীয় বাহিনীর কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ কর। নতুবা তোমাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হবে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে সকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দফতর ঢাকা থেকে প্রথমবারের মতো জেনারেল নিয়াজী সঙ্কটপূর্ণ পরিস্থিতির কথা স্বীকার করেন।

গুরুতর পরিস্থিতিতে তিনি তার সরকারের কাছে আবেদন জানাতে থাকেন চীন যেন অবিলম্বে ভারত ভূখণ্ডে আক্রমণ চালায়, তা না হলে পরাজয় ঠেকানো যাবে না। রাওয়ালপিন্ডিতে পাঠানো এক সঙ্কেত বার্তায় বলা হয় পরিস্থিতি নিদারুণ সঙ্কটপূর্ণ। এ বার্তায় স্পষ্ট হয়ে যায়, দখলদার বাহিনীর মনোবল একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সময় পাকিস্তানকে সামরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। প্রেসিডেন্ট নিক্সন   মার্কিন সপ্তম নৌ-বহরকে বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। ‘অত্যাসন্ন হামলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য সপ্তম নৌবহরকে করাচীর সন্নিকটে আরব সাগরে না পাঠিয়ে তার প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার পূর্বে বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়।

যাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা নিরাপদে সরে আসতে পারে। বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তান বাহিনী যখন পর্যুদস্ত, আত্মসমর্পণ ছাড়া যখন তাদের আর কিছুই করার নেই, ঠিক তখনই বঙ্গোপসাগরের দিকে আসতে থাকে মার্কিন সপ্তম নৌ-বহর। বাংলাদেশ প্রশ্নে শ্রীমতী গান্ধীর যুক্তি, দৃঢ়তা এবং বিস্ময়কর আন্তর্জাতিক জনসংযোগের ফলে বিশ্ব জনমত তখন বাংলাদেশের পক্ষে আসে। এমন কি আমেরিকার মিত্ররাও সটকে পড়ে।

অবশ্য এই খবরটির সঙ্গে আরেকটি খবর আসে। কুড়িটি রুশ রণতরীও যাত্রা করেছে বঙ্গোপসাগরের পথে। অতএব ভয় নেই। নয়া দিল্লির কর্তৃপক্ষ স্পষ্ট করে জানান, বাংলাদেশ থেকে দখলদার পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীকে সরিয়ে নেয়ার কোন রকম এখতিয়ার মার্কিন নৌবহরের নেই। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে এখন ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ।

যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রাষ্ট্রদূত সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়ে দেন, পাকিস্তানের সৈন্য ও বেসামরিক লোকজন সরিয়ে দিতে বঙ্গোপসাগরের যদি মার্কিন নৌ-বহর ঢুকতে চায় তাহলে পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। এই কাজকে আমরা শত্রুতা বলে গণ্য করব।

মার্কিন নৌ-বহরের জন্য বঙ্গোপসাগর ছিল ৪-৫ দিনের যাত্রাপথ।   নিক্সনের উদ্দেশ্য সফল হয়নি।   সপ্তম নৌ-বহর যখন যাত্রা শুরু করে তখন অর্থাৎ ৯-১০ ডিসেম্বরে ভারত ও বাংলাদেশের মিলিত বাহিনীর অভিযানের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী দ্রুত পশ্চাদাপসরণে ব্যস্ত। দ্রুত মুক্ত হতে থাকে ঢাকার আশপাশের জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান একের পর এক অঞ্চল।

মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে শত্রুমুক্ত হয়- দাউদকান্দি, গাইবান্ধা, কপিলমুনি, ত্রিশাল, নকলা, ঈশ্বরগঞ্জ, নেত্রকোনা, পাইকগাছা, শ্রীপুর, অভয়নগর, পূর্বধলা, চট্টগ্রামের নাজিরহাটসহ বিভিন্ন এলাকা।  

ওআ/এস এস