ন্যাভিগেশন মেনু

৩ ডিসেম্বর

হানাদারদের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা যৌথবাহিনীর


কলকাতার এক জনসভায় ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর বিকেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী জানান, পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, যোধপুর ও আগ্রার বিমানবন্দরের স্থাপনাসমূহ ও রাডার স্টেশনে আকস্মিক বোমাবর্ষণ করে সর্বাত্মক যুদ্ধের সূচনা করেছে।

এদিন কলকাতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। খবর আসে- পাকিস্তান আক্রমণ করেছে ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, আগ্রাসহ বেশকিছু জায়গায়।  বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন ইন্দিরা গান্ধী।

চিফ সেক্রেটারি নির্মল সেন গুপ্ত একটা টেলেক্স হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। টেলেক্সটা হাতে নিয়ে গম্ভীরভাবে চোখ বুলালেন তিনি। সভা আর অগ্রসর হলো না। ইন্দিরা গান্ধী ব্রিগেড প্যারেড ময়দানের সভা সংক্ষিপ্ত করে সন্ধ্যায় দিল্লি রওনা হয়ে যান।

ভারত ভূখণ্ডে পাকিস্তানের আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানালো বাংলাদেশ সরকার। রাতারাতি গড়ে উঠল দুই রাষ্ট্রের যৌথ সামরিক কমান্ড। শুরু হলো মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ অভিযান। 

ভারতীয় বিমানবাহিনীর দেওয়া অটার এয়ারক্রাফট, হেলিকপ্টার এবং ডাকোটা বিমান দিয়ে ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুর বিমান ঘাঁটিতে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠিত হয়। ডাকোটা বিমান যেটা ছিল যোধপুরের মহারাজার ব্যক্তিগত বিমান।

বিমানটি তিনি ভারতীয় বিমানবাহিনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ মুক্তিফৌজকে উপহার দেন। দ্বিতীয় বিমানটি ছিল কানাডীয় অটার বিমান, তৃতীয় বিমানটি ছিল ফরাসী হেলিকপ্টার নাম-এলুয়েট ৩। এই দুইটি বিমান ভারতীয় বিমানবাহিনী বাংলাদেশ মুক্তিফৌজের বিমানসেনা ইউনিটকে উপহার দিয়েছিল।

এই বিমানগুলো নিয়েই স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে মুক্তিফৌজের নিজস্ব পাইলট ও টেকনিশিয়ানদের নিয়ে গঠিত বিমানবাহিনী দীর্ঘদিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।

সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিফৌজের ক্ষুদ্র এই বিমানবাহিনী পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে মধ্যরাত ১২:০১ মিনিটে ঢাকার নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে এবং ১২:১০ মিনিটে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় গুপ্তখালি এলাকার বিমানের তৈল সংরক্ষণাগারে আকস্মিক আক্রমণের মাধ্যমে মধ্যরাতে বিমান যুদ্ধের সূচনা করে।

বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ঐতিহাসিক অধ্যায়ে পদার্পণ করেন এবং পাক বাহিনীর মারাত্মক ক্ষতি সাধনে সক্ষম হয়। পুনরায় ওই দুটি ডিপোতে আঘাত করার জন্য একই সময়ে দুই ভাগে আক্রমণ চালানো হয়।

ভারতের কৈলাশহর থেকে অটার বিমানটি আক্রমণ করে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ডিপোতে এবং ভারতের তেলিয়ামুরা থেকে অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার আক্রমণ চালায় নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ডিপোতে। অটার বিমানটি সমুদ্র বরাবর পথ ধরে পতেঙ্গার তেলের ডিপোর কাছে এসে বোমা হামলা করে। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম ও ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ এ অভিযান পরিচালনা করেন।

এদিকে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম হামলা চালান অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারটি নিয়ে। নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে পৌঁছেই তেলের ট্যাঙ্কারের ওপর বোমা নিক্ষেপ করেন তাঁরা। মুহূর্তের মধ্যে ট্যাঙ্কারগুলো বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়।

মধ্যরাত ১২:২০ মিনিটে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী জানান, পাকিস্তান আজ ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তানের আক্রমণ ঐক্যবদ্ধভাবেই প্রতিহত করতে হবে।

তিনি দেশবাসীকে চরম ত্যাগ স্বীকারের জন্য তৈরি হবার আহ্বান জানান। আজ বাংলাদেশের যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধ মোকাবেলায় দেশকে তৈরি করা ছাড়া আমাদের আর কোন বিকল্প ব্যবস্থা নেই।

রাতে যশোর, চট্টগ্রাম, তেজগাঁও এবং কুর্মিটোলায় বিমান হামলা শুরু হয়। আক্রমণ শুরুর কৃতিত্ব নবগঠিত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে (কিলোফ্লাইট) দেয়া হয়। ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার অধিনায়কত্বে ঘোষিত হয় বাংলাদেশের ভারত যৌথ কমান্ড।

ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী হলো মিত্রবাহিনী। গভীর রাতেই মিত্রবাহিনী অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্ত এলাকায় অবস্থিত মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়।

বাংলাদেশের সশস্ত্র ও মুক্তি বাহিনীর সহায়তায় মিত্র বাহিনীর নবম ডিভিশন গরিবপুর-জগন্নাথপুর হয়ে যশোর ঢাকা মহাসড়কসহ চতুর্থ ডিভিশন ষষ্ঠ ডিভিশনের বেশ কয়েকটি এলাকার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। যশোর কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, জেলার আরও কয়েকটি থানা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে।

ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের পাক অবস্থানগুলোকে ঘিরে ফেলার প্রচেষ্টায় সীমান্তের ৭টি এলাকা দিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ পরিচালনা করে। মুক্তি বাহিনীর সর্বাত্মক হামলায় পাকিস্তানি হানাদাররা দিশেহারা হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের বেশে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

তারা একের পর এক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত করে পাক সেনাদের ফাঁদে ফেলেন। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। মিত্রবাহিনীর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে সম্মুখযুদ্ধে এগিয়ে যায় বীর বাঙালী। 

ওআ/ এস এস