ন্যাভিগেশন মেনু

স্বাধীনতার ৫৩ বছর: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বাংলাদেশ


২৬ মার্চ ২০২৪। রক্তসাগর পাড়ি দেয়া স্বাধীনতার ৫৩ তম বার্ষিকীতে পদার্পণ করলো আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ। ২৫ মার্চ কাল রাতে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা চালায় তার পরপরই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে  বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন।ত্রিশ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যু্দ্ধে অর্জিত এই স্বাধীনতা বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গৌরবময় ও সর্বশ্রেষ্ঠ অধ্যায়। 

এই স্বাধীনতাযুদ্ধে আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করেছিলেন দেশের ভবিষ্যৎ রচনার জন্য।  মূলত অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনাকে সামনে নিয়ে বাংলাদেশের সৃষ্টি যা মূলত গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা,সমাজতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদ এই চার নীতির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সেই স্বাধীনতার কতটুকু সুফল ভোগ করতে পেরেছি আমরা? কতটুকু পূরণ হয়েছে। কি আমাদের প্রত্যাশা? আজ জাতির কাছে নব প্রজন্মের কাছে সেটি অনেক বড় একটি প্রশ্ন। স্বাধীনতার মূলমন্ত্র গণতন্ত্র, সমতা,সামাজিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায় বিচারে আমরা কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছি বা পারছি? রাজনীতি,শিক্ষা, অর্থনীতি,সমাজনীতিতে দেশ কতটুকু এগিয়েছে?

স্বাধীনতা মানে শুধু যেনতেন আঁকিবুকি করে একটি লাল বৃত্ত তৈরি নয়,বরং সূর্যাকার সেই বৃত্তটিকে মহাকাশে পৌঁছে দিয়ে পুরো জাতির জন্য প্রাপ্য আলোটুকু নিশ্চিত করার মধ্যেই স্বাধীনতার সাফল্য লুকায়িত। বিদেশী শাসনের অবসান হলেই দেশের মানুষের মুক্তি অর্জিত হয় না। 

এই উপলব্ধি থেকেই বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষনে বলেছিলেন "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম"। স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী ধাপ হচ্ছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি অর্জনের লড়াই।অন্যদিকে স্বাধীনতার মূলনীতির কথা যদি বলি তাহলে প্রথমে গণতন্ত্রের কথা আসে যা বারবার সামরিক স্বৈরাচার নস্যাৎ করে দিয়েছে আমাদের সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান।স্বাধীনতা বিরোধীদের খুশি করতে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষ কাটছাঁট করেছে সামরিক জান্তারা। সমাজতন্ত্র হয়েছে ব্যর্থতায় পর্যবসিত, আর জাতীয়তাবাদ রয়েছে নামেমাত্র আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ।

 

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন দেশে এসে বঙ্গবন্ধু সরকারের নেতৃত্ব নিলেন।দেশ প্রেমিক জাতীয় নেতা হিসাবে যাত্রা শুরু করলেন।নবজাত বাংলাদেশ-এ একটি টেকসই রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলার পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক আইন প্রণয়ন যেমন জরুরি ছিলো,তেমনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে পুর্ণবাসন,পুর্ণগঠন এবং নবনির্মানের কাজটিও জরুরি ছিলো।বঙ্গবন্ধু একটি সংবিধান রচনায় প্রথমে হাত দিলেন যে সংবিধানে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ স্থান পেল।একই সাথে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুর্নগঠনে হাত দেন। বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে নতুন রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলা ও পুর্ণবাসন ও পুর্ণগঠনের কাজ মাত্র দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন করেছিলেন। ঘাতকের হাতে প্রাণ দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সময় পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। 

এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ চরম প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলো।ভৌত কাঠামো সংস্কার করেছিলেন,সমুদ্র বন্দরের মাইন অপসারণ,ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার, খাদ্য সংগ্রহ, স্বাস্থ্যসেবা, বিদেশি ঋণ ও সাহায্য নিশ্চিত করা,শিক্ষা ক্ষেত্রে আমুল পরিবর্তনের জন্য যুগোপযোগী একটি শিক্ষা কমিশন গঠন, কৃষি ও শিল্পের বিকাশে পদক্ষেপ গ্রহণ সহ প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিলো।আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিচার করলে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জন্যে বড় প্রয়োজনটি ছিলো বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের স্বীকৃতি।  ৭২-এর গোড়ায় যে দেশটি স্বীকৃতি ও বান্ধবহীন ছিলো সে দেশটি ৭৪- এর সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি মর্যাদা পূর্ণ আসন করে নিয়েছিলো।৭৪-এর ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ পেয়েছিলো।৭৫-এর শুরুতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া দেশের সংখ্যা ছিলো ১৩৪।

১৯৭৫ সালে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসভায় বলেছিলেন "বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছে শোষনহীন সমাজ কায়েম করার জন্য এবং আমরা চাই শোষিতের গণতন্ত্র, আমরা চাই না শোষকের গণতন্ত্র। তাই এক নম্বর হল- দুর্নীতিবাজ খতম করা,দুই নম্বর হল- কলকারখানা ক্ষেতে খামারের প্রোডাকশন বাড়ানো,তিন নম্বর হল পপুলেশন প্লানিং চার নম্বর হল জাতীয় ঐক্য"। আজও বাংলাদেশের জনসাধারণের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য এই চারটি কর্ম গুরুত্বপূর্ণ।কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্যে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে রাষ্ট্র দর্শন সেই শোষনহীন অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রচিন্তাকেও হত্যা করা হয়েছে।

১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত স্রোতে প্রবাহিত হয়েছে।এই সময়টুকু বাঙালির জীবন থেকে অপচয় হয়ে গেছে।

সামরিক ও বেসামরিক দুঃশাসনের ফলে বঙ্গবন্ধুর সূচিত উন্নয়নের ধারা প্রবলভাবে ব্যাহত হয়।প্রত্যাশিত ও সম্ভাব্য উন্নয়ন তেমন হয়নি বরং কোন কোন ক্ষেত্রে দেশ পিছিয়ে পড়েছে এবং পশ্চাদগামী হয়েছে। দীর্ঘ ছয় বছরের নির্বাসন শেষে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিয়ে দেশে আসেন শেখ হাসিনা।মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধার এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধু কন্যার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।তিনি স্বজন হারানো শোককে শক্তিতে পরিনত করেন এবং দেশের মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন।বিলম্বে হলেও আজ বঙ্গবন্ধুর শোষনহীন সোনার বাংলা গড়ার কাজ অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বঙ্গবন্ধু তার শাসনকালে যে সব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন আজ ৫৩ বছর পরেও সে সব সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে তার কন্যা শেখ হাসিনা সরকারকেও।আজ অর্থনৈতিকভাবে বা অবকাঠামোগতভাবে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ এক রোল মডেল সারা বিশ্বে।তলাবিহীন রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত বাংলাদেশ আপন দক্ষতায় স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় ভূষিত হবে।বেড়েছে কর্মসংস্থান,রপ্তানি বানিজ্য। এক থেকে দেড় কোটি বাংলাদেশি বিদেশে চাকরি করে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছে।কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশ জাতীয় আয়ের প্রধান উৎসকে কৃষি থেকে তৈরি পোষাক আর জনশক্তিতে রূপান্তর ঘটিয়ে ব্যাপক উন্নয়নের দ্বার খুলেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৪ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। খাদ্য শস্য উৎপাদন ৪৫১ মেট্রিক টন ছাড়িয়েছে।মথাপিছু আয় ১৯৭১ সালে ছিল ৬৭১ টাকা যা বর্তমানে দেড় লক্ষ টাকা।বড় বড় মেগা প্রজেক্ট গ্রহণ ও বাস্তবায়িত হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তবতা। স্মার্ট বাংলাদেশ, স্মার্ট জাতি গঠনই পরবর্তী লক্ষ্য যা বাস্তবায়নের জন্য বহুমুখী কার্যক্ষমতা সম্পন্ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ স্থাপনের পদক্ষেপ নিয়েছে।২০২৪ সালের মধ্যে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন করতে যাচ্ছে। 

২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত, স্মার্ট বাংলাদেশ হিসাবে গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে ভিশন- ২০৪১ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। মানব সম্পদ উন্নয়ন,নারীর ক্ষমতায়ন,দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা ও নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ১৮.৭ শতাংশে,স্বাক্ষরতার হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৬.৮ শতাংশে।ডেল্টা প্লান- ২১০০ আমাদের প্রজন্মকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে রক্ষা এবং একটি উন্নত ভবিষ্যৎ গড়তে প্রণয়ন করা হয়েছে।কোভিড-১৯ মহামারি থেকে জীবন বাঁচাতে মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছেন।জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে আইসিটির ব্যবহারে প্রচারনার জন্য শেখ হাসিনকে " আইসিটি সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়।মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই অর্জনগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশেকে যেমন করেছে প্রসংসিত তেমনি হয়েছে সম্মানিত।

 

আজ ঝলমলে দালানকোঠা হাইওয়ে,রাস্তা,ফ্লাইওভার,ব্রিজ, মাথাপিছু আয়, জিডিপি দেখে খুশি হলেও বৈষম্য ও গণতন্ত্রের বেহাল দশা আর নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র দেখে মন ব্যথিত হচ্ছে।আজ দেখতে পাই দেশের সিংহভাগ অর্থ কয়েক হাজার কোটিপতির ঘরে বৃত্তাবদ্ধ হয়েছে।দেশের অর্থ কালো টাকার মালিকেরা বিদেশে পাচার করে দিয়েছে বা দিচ্ছে।বিভিন্ন দেশে বেগম পাড়ার মতো অবাঞ্ছিত কালো টাকার ধনী পাড়া গড়ে উঠেছে।সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে ধর্মান্ধতা এবং মৌলবাদের বিষবাষ্প।এদেশেই আমরা দেখেছি হলি আর্টিজান ম্যাসাকার দেখেছি ৬৩ জেলায় বোমা বিস্ফোরণ দেখেছি মৌলবাদী শক্তির দাবির মুখে পাঠ্যপুস্তক বদলে দিতে দেখেছি রামু,নাসিরনগর,মুরাদনগর ও শাল্লায় সংখ্যালঘুদের উপরে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলা যা কাম্য হতে পারে না।এই বিষয়গুলোই আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে ব্যবধান সৃষ্টি করে চলেছে।

 তবুও স্বপ্ন দেখি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি সত্যিকারের শোষণমুক্ত,দারিদ্রমুক্ত,বঞ্চনা মুক্ত দুর্নীতিবিহীন একটি জাতিরাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ যেন প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্ব দরবারে।বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে,খেয়ে পরে সুখে থাকবে এটাই ছিলো বঙ্গবন্ধুর সাধনা।আর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও সাধনাকে বাস্তব রূপ দিয়ে চলেছেন তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

 

মোঃ আরিফুল ইসলাম

প্রভাষক

ইতিহাস বিভাগ

হাবীবুল্লাহ্ বাহার কলেজ, ঢাকা।