ন্যাভিগেশন মেনু

রংপুর বিভাগে সমতলে চা আবাদ বাড়ছে , কাঁচা পাতার দাম না পেয়ে সেট বাগান উপড়ে ফেলছে অনেক চাষী


রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলার সমতল ভূমিতে চা আবাদ বাড়ছে। চাষীরা দীর্ঘদিনেও কাঁচা পাতার দাম না পেয়ে  বাগান উপড়ে ফেলছে।  

বাংলাদেশ চা বোর্ড আঞ্চলিক কার্যালয়, পঞ্চগড় অফিস সূত্রে জানা যায় রংপুর বিভাগের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলায় ১২ লাখ ১০ হাজার ৬৬০ একর সমতল জমিতে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ পরিসরে চা-আবাদ হয়েছে।  পঞ্চগড় চা বোর্ডের অধীন ৫টি জেলায় অনুমোদিত টি কারখানা রয়েছে ৫৮টি তদ্মধ্যে উৎপাদনে আছে ২৮টি। 

পঞ্চগড় জেলায় ২০০০ সালের দিকে তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি লিমিটেড ও কাজী এন্ড কাজী পঞ্চগড়ে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু করে। পরবর্তীতে  প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলায় ক্ষুদ্র পর্যায়ে ২০২১ সালের মধ্যে ৫০০ হেক্টর জমি নতুন করে চা চাষের আওতায় আনতে সেপ্টেম্বর ’১৫ থেকে জুন ’২১ মেয়াদে ৭৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘ দেশের উত্তরাঞ্চলে ছোট ছোট চা চাষের সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে চা বোর্ড। প্রকল্পের সমাপ্তি শেষে চা উৎপাদন বেড়েছে ২৫ দশমিক ২২ লাখ কেজি থেকে ১৪৫ দশমিক ৪ লাখ কেজি। উত্তরবঙ্গের পাঁচ জেলা— পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, লালমনিরহাট ও নীলফামারীতে ৯টি নিবন্ধিত চা বাগান, ২১টি অনিবন্ধিত চা বাগান এবং ৮ হাজার ৬৭টি ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান (নিবন্ধিত ১৭৪৫) মোট ১১ হাজার ৪৩৩ দশমিক ৯৪ একর সমতল জমিতে চা চাষ হয়েছে।

এই চা বাগানগুলো থেকে ২০২৩ সালে ১ কোটি ৭৯ লাখ ৪৭ হাজার ২৩০ কেজি সবুজ পাতা চা উৎপাদন হয়েছে। পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট এর ২৮টি প্রক্রিয়াজাত কারখানায়  ১ কোটি ৪৫ লক্ষ ৪০ হাজার কেজি চা উৎপন্ন হয়েছে। 

বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিটিআরআই) একটি উপকেন্দ্র  প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ চা বোর্ড। পঞ্চগড়ে ২০০১ সালের দিকে চা চাষের বিপুল সম্ভাবনা দেখা দেয়। রংপুর বিভাগের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও দিনাজপুর জেলায় ক্ষুদ্র পর্যায়ে সমতলে সবুজ চা চাষ হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলে সমতলের চা বাগান ও ক্ষুদ্র চা চাষ থেকে গত বছর (২০২১) রেকর্ড পরিমাণ ১৪ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন কেজি চা জাতীয় উৎপাদনে যুক্ত হয়েছে।  

উত্তরাঞ্চলে ২০১৯, ও ২০২১ সালে উৎপাদিত চায়ের পরিমাণ যথাক্রমে ৯ দশমিক ৬০ মিলিয়ন কেজি, ২০২০ সালে ১০ দশমিক ৩১ মিলিয়ন কেজি, ২০২১ সালে ১৪ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন কেজি। অন্যদিকে চট্টগ্রাম ভ্যালিতে ২০১৯, সালে উৎপাদিত চায়ের পরিমাণ যথাক্রমে ১১ দশমিক ৭৫, ২০২০ সালে ১১ দশমিক ২৩ ও ২০২১ সালে ৯ দশমিক ৫২ মিলিয়ন কেজি।  উত্তরাঞ্চলে বাণিজ্যিক চা চাষ আজ থেকে ২১ বছর পূর্বে শুরু হয়েছে। পঞ্চগড়ে ২১ বছরে চায়ের উৎপাদন ছাড়িয়ে গেছে ১৬১ বছর আগে শুরু হওয়া চট্টগ্রামকে।

চা বাগানের মালিকরা জানান,  বছরে প্রতি মৌসূমে ৬-৭টি রাউন্ডে বাগানের সবুজ কাঁচা পাতা তুলে বিক্রয় করতে পারেন। কিন্তু এই পাতা বিক্রয় করার সময় প্রতিটি রাউন্ডে বাগান মালিকদের নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। কখনো কারখানায় কাঁচা পাতার নি¤œহারে দাম নির্ধারণ আর কর্তনের কারণে বাগানের পাতা বিক্রি ও কারখানায় সরবরাহ দিয়ে চাষীদের হাতে কোন টাকা থাকে না। বিশেষ করে চলতি মৌসূমের প্রথম ও শেষ রাউন্ডে বাগানের পাতা বিক্রির টাকা দিয়ে চাষীরা বাগান পরিচর্যার কাজও সম্পন্ন করতে পারে না। পঞ্চগড়ের সবুজ কাঁচা পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার মালিকগণ একতরফা সিন্ডিকেট করে চা চাষীদের ছাড়াই পাতা-ক্রয়ের দর-দাম নির্ধারণ করেন। 

এই নীতি নির্ধারনী সভায় বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় জেলা অফিসের কর্মকর্তা, কারখানার মালিক, রাজনৈতি নেতা ও জনপ্রতিনিধি, পঞ্চগড় পুলিশ সুপার, জেলা প্রশাসক পঞ্চগড় সভায় সমন্বয় করে সবুজ কাঁচা পাতার দাম এবং ডাস্ট কর্তন হার নির্ধারণ করে দেন। কিন্তু কারখানার মালিকগণ সভার সিদ্ধান্তসমূহকে বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখায়ে তাদের মনগড়া মূল্য ও ডাস্ট কর্তন হার নির্ধারণ করেন।

ক্ষুদ্র চা চাষীদের অভিযোগ, চলতি মৌসূমে আকাশে বৃষ্টিপাত ও সকালে কোন শিশির কনা নেই। গভীর নলকূপ আর শ্যালো মেশিন দিয়ে বাগানে পানি সেচ দিয়ে তালগোল খেতে হচ্ছে। এ মৌসূমে লাগার খরার কারণে বাগানের চা গাছ পুড়ে মরে যাচ্ছে। বাগানে লাল মাকড় সহ নানা রোগ বালায়ের প্রাদূর্ভাব বেড়েছে। ক্ষেত্রে রোগ বালাই দমনের সার-কীটনাশকের দামও চড়া। বর্তমানে চলতি বছরে বাগানে সবুজ চা পাতা তোলার প্রথম রাউন্ড মৌসূম শুরু হয়েছে। 

চা বাগান থেকে খসখসে শুকনা সবুজ কাঁচা পাতা তোলে কারখানায় সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু চা কারখানাগুলো প্রতিকেজি সবুজ কাঁচা পাতা প্রায় ১০-১৫ টাকা দরে কেনার পাশাপাশি ৪০-৫০% হারে কর্তৃনপূর্বক চাষীদের মূল্য পরিশোধ করায় অর্থনৈতিকভাবে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। পঞ্চগড়ে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে সবুজ কাঁচা পাতার মূল্য নির্ধারণ নিয়ে আন্দোলন প্রতিবাদ করার পরও ন্যায্য মূল্য না পেয়ে অনেক ক্ষুদ্র  চা চাষী সেট বাগান উপড়ে ফেলছে। 

অনেক বাগানের মালিক ক্ষেত্রের পরিচর্চা করছে না। ফলে চা বাগানের অবস্থা দিনদিন নাজুক হয়ে পড়ছে। চাষীদের দাবী, কারখানা মালিকগণ প্রতিকেজি চা পাতা কমপক্ষে ২০-২৫ টাকা হারে ক্রয় করলে তাদের চাষাবাদে অর্থনৈতিক লোকসান কিছুটা কমবে। সেই সংগে সৃজনকৃত বাগান উপরে না পেলে বাগান পরিচর্চায় মনোনিবেশ বাড়বে।

এবিষয়ে পঞ্চগড় আঞ্চলিক চা বোর্ডের উন্নয়ন কর্মকর্তা মোঃ আমির হোসাইন বলেন, ইতোমধ্যে পঞ্চগড় জেলায় দেশের তৃতীয় চা নিলাম কেন্দ্র স্থাপন হয়েছে। তবে উৎপাদনের তুলনায় বাজারে চাহিদা কম থাকায় চা পাতার দাম কমেছে। 

কিন্তু বিপুল সম্ভাবনাময় গ্রীণ অর্থনীতি শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য চাষীদের ভাল মানের পাতা (২টি কুড়ি একটি পাতা) উৎপাদন পূর্বক কারখানায় সরবরাহ করতে হবে। কারখানায় সরবরাহকৃত সবুজ পাতা ্দ্বারা ভাল মানের চা প্রস্তুত করে বেশি দামে নিলামে বিক্রয় করবে। তখন চাষীরাও সবুজ পাতার ভাল দাম পাবে। সর্বোপরি পঞ্চগড়ে চা শিল্পের মানোন্নয়ন ও সংকট উত্তরণের জন্য চা চাষী ও কারখানা মালিকদের যৌথভাবে কাজ করতে হবে।