ন্যাভিগেশন মেনু

অভাবকে জয় করে জয়ীতা শিরিন


নিম্নমধ্যবিত্ত এক কৃষক পরিবারে বেড়ে ওঠা শিরিন সুলতানার। দুই ভাইবোনের মধ্যে তিনি বড়। অভাবের সংসারেও মা শাহানা বানুর প্রবল ইচ্ছা ছিলো মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করা। কিন্তু বাবা ইসমাইলের কথা, মেয়েকে যেটুকু পড়ানো হয়েছে তা কম কিসে! তাইতো মায়ের ইচ্ছাপুরন না করেই স্বামীর সংসারে যেতে হয়েছে শিরিনকে।

শিরিনের বাবার বাড়ি দিনাজপুর জেলার বিরামপুর থানার মোহনপুর গ্রামে হলেও স্বামীর বাড়ি নওগাঁর রানীনগরের এক প্রত্যন্ত গ্রামে হলেও বর্তমানে সপরিবারে নওগাঁ শহরের পোষ্ট অফিস পাড়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।

অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে নিজের অক্নান্ত প্রচেষ্টায় আজ তিনি সফল জয়ীতা।

গতবছর উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়ীতাদের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসেবে তিনি প্রথম হয়েছেন। এখন তার অধীনে প্রায় শতাধিক নারীকর্মী কাজ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।

১৯৯৫ সালে বিরামপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৯৮ সালে বিরামপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন শিরিন সুলতানা। ওই কলেজে ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষে পড়া অবস্থায় ২০০৩ সালে পারিবারিকভাবে নওগাঁর রানীনগরের গোনা গ্রামের ইদ্রিস আলী মোল্লার সাথে বিয়ে হয়। স্বামীর পরিবারের অবস্থাও অনেকটাই তার বাবার বাড়ির মতো। বলতে গেলে বাড়িটুকুই সম্পদ।

তবে ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ ও নম্র ভদ্র হওয়ায় বিয়ে দেয়া হয়। শ্বশুরের পরিবারে মোট ৯ সদস্য হওয়ায় অনেকটা কষ্ট করে চলতে হয়েছে তাকে।

একদিকে বেকার স্বামী অপরদিকে সংসারে দৈন্যদশা। শিরিনের শেলাইয়ের কাজ জানা থাকায় প্রতিবেশীদের জামা কাপড় সেলাই করে আয় করা শুরু করেন। এরমধ্যে বিয়ের প্রায় দেড় বছর পর স্বামীর ভূমি অফিসের অফিস সহায়ক পদে চাকরি হলে নওগাঁ শহরের চলে আসেন।

২০০৬ সালে এক ছেলে সন্তানের মা হন। ২০০৭ সালে ‘রূপমাধুরী বিউটি পার্লার’ থেকে ৩ মাসের একটা প্রশিক্ষণ নিয়ে ভাড়া বাসার তিনটি ঘরের মধ্যে একটা ঘরে নিজেই বিউটি পার্লার খুলে বসেন। বাসাতে বিউটি পার্লার হওয়ায় মানুষ কম আসতো। এরপর তিনি অন্য কিছু করার পরিকল্পনা করেন।

২০০৯ সালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে সেলাইয়ের উপর প্রশিক্ষণ নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এরপর ২০১৩ সালে নওগাঁ সদর উপজেলা যুব উন্নয়ন থেকে এক পরিচিত বড় ভাইয়ের মাধ্যমে ভর্তি হয়ে সেলাই ও ব্লক বাটিকের উপর তিন মাসের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরতে হয়নি।

প্রশিক্ষণ শেষে কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে ২৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বুটিকসের এবং বিউটি পার্লারের প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনে কার্যক্রম শুরু করেন।

এছাড়া যুব উন্নয়ন থেকেই ভ্রাম্যমান প্রশিক্ষক হিসেবে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুই বছরের মধ্যে তিনি বুটিকসের আয় থেকে ঋণ পরিশোধ করে আবারও ৫০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। ২০১৪ সালে তার প্রতিষ্ঠান ‘সেজোতি বিউটি পার্লার অ্যান্ড বুটিক ফ্যাশন’ এর রেজিস্ট্রেশন করেন। তার এ প্রতিষ্ঠান থেকে ঢাকা, দিনাজপুর, রংপুর, সৈয়দপুর এবং রাজশাহী থেকে পাইকাররা এসে পোশাক কিনে নিয়ে যান।

অর্থনৈতিকভাবে সফলতা অর্জনকারী শিরিন সুলতানা বলেন, 'এক সময় অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেড়ে উঠেছি। এরপর স্বামীর বাড়িতে এসেও যুদ্ধ। আল্লাহর অশেষ কৃপায় এখন আর্থিক দিক দিয়ে স্বচ্ছলতা অর্জন করতে পেরেছি। আমার অধীনে প্রায় শতাধিক নারী কর্মী বুটিকসের কাজ করে প্রতিমাসে তারা ৩-৮ হাজার টাকা আয় করছেন। প্রতিমাসে প্রায় ৭০-৮০ হাজার টাকার মতো থ্রিপিস, জামা, শাড়ি, পাঞ্জাবিসহ ব্লক বাটিকের তৈরীকৃত অন্যান্য পোশাক বিক্রি হয়ে থাকে। যা থেকে সব খরচ বাদে প্রায় ২৫-৩০ হাজার টাকার মতো লাভ আসে।  এছাড়া বিউটি পার্লার থেকে মাসে আসে প্রায় ১৫-২০ হাজার টাকা।

তিনি বলেন, 'এ কাজে স্বামীর সার্বিক সহযোগীতা ও উৎসাহ পেয়েছি। তার চাকরি এবং আমার ব্যবসা দুজনে পরিশ্রম করেছি।

গত ২০১৮ সালে নওগাঁ মুখবধির বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হয়েছি। আমার কর্মজীবনের আয় দিয়ে বাবার বাড়িতে প্রায় দেড় বিঘা জমি কিনেছি। এছাড়া শহরে বসবাসের মতো একটা বাড়ি তৈরী করেছি। ছেলেকে ভালো প্রাইভেট স্কুলে পড়াশুনা করাচ্ছি।'

তরুনদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমি যেভাবে কষ্ট করে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এখন নতুন যদি কেউ বুটিকসে আসতে চায় তাদেরকে কষ্টটা কম করতে হবে। কারণ এ কাজটা শিখানোর মানুষ তখন কম ছিলো। বর্তমানে যারা আসবে/আসতেছে তারা ইন্টারনেট পারদর্শী। তারা অনলাইনেও ব্যবসা করতে পারবে। যা আমরা তখন পারিনি। তবে চাকরির পেছনে না ঘুরে ওই টাকা যদি ব্যবসার কাজে লাগাই তবে বেশি সফলতা আসবে বলে মনে করি। তবে ধৈর্য্যরে সাথে লেগে থাকতে হবে।'

স্বামী ইদ্রিস আলী মোল্লা বলেন, 'স্ত্রী যখন এ কাজ শুরু করতে চেয়েছিলো তখন আমার পরামর্শ চেয়েছিলো। সংসার ও সন্তান সামলিয়ে যদি কাজ করতে পারো তাতে আমার কোন আপত্তি নাই। কারণ এ কাজটা খুবই কঠিন ও ঝামেলার। এরপর সে কাজ শুরু করে। এছাড়া আমার চাকরির সামান্য বেতনে সংসার ঠিকমতো চালানো যেতো না। এরপর ভাবলাম, তার ব্যবসা ও আমার চাকরির বেতনে দু’জনে টাকায় সংসারে উন্নয়ন হবে। স্ত্রীকে এ কাজে যথেষ্ট সহযোগীতা করে থাকি।'

সিবি/এডিবি