ন্যাভিগেশন মেনু

গোপন অডিওতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা যেভাবে ধরা খেলেন

র‍্যাব ও পুলিশের বিরুদ্ধে বিতর্কিত মন্তব্য

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) এক ‘মহা দুর্নীতিবাজ’ কর্মকর্তা এবং একটি ইভেন্ট অর্গানাইজারের মধ্যেকার ফাঁস হওয়া অডিওতে রাজধানীর অভিজাত গুলশান ও বনানী এলাকায় অবস্থিত বিভিন্ন বারগুলোতে ব্যাপক ঘুষ এবং অবৈধ অর্থ নেওয়ার ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে।

সম্প্রতি ফাঁস হওয়া এই অডিওতে গুলশান ও বনানী এলাকায় অবস্থিত বিভিন্ন পাঁচ তারকা হোটেল ও বার থেকে নিয়মিত ঘুষ বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া গেছে ।

গত বছরের ১৮ নভেম্বর রাজধানীর বনানী এলাকায় পেয়ালা ক্যাফে নামের একটি রেস্তোরাঁয় দুজনের সাক্ষাতের সময়  এই অডিও কথোপকথন রেকর্ড করা হয়।

কয়েক মাসব্যাপী অনুসন্ধানের পর অবশেষে এই প্রতিবেদকগণ অভিযুক্ত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কর্মকর্তার এবং ইভেন্ট অর্গানাইজারের বিস্তারিত পরিচয় জানতে পেরেছেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তা মোঃ সুমনুর রহমান ডিএনসির গুলশান সার্কেলের পরিদর্শক এবং রাইসুল ইসলাম জুয়েলকে ইভেন্ট অর্গানাইজার হিসাবে শনাক্ত করা গেছে।

গত ৬ মে বাংলাদেশ পোস্ট-এর সঙ্গে আলাপকালে রাইসুল ইসলাম জুয়েল নিজেই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিদর্শক সুমনুর রহমানের সাথে ফাস হওয়া অডিও কথোপকথনের সত্যতা নিশ্চিত করেন।

তবে ডিএনসির পরিদর্শক সুমনুর তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বাংলাদেশ পোস্ট প্রায় ১৪ মিনিটের অডিও রেকর্ডের একটি কপিও হাতে পেয়েছে। এখানে অডিও কথোপকথনের হুবহু পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো:

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মোঃ সুমনুর রহমান: ''সেদিন তোমার সাথে দেখা করে আরেকজনের সাথে অন্য একটি প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম। তাই তোমারে একটা মেসেজ দিয়া জানাইছিলাম যে, তার সাথে একটু কথা কও।''

ইভেন্ট অর্গানাইজার রাইসুল ইসলাম জুয়েল: ''হ্যা, সে ডাইরেক্ট আপনার কথা কইসে। আপনি নাকি আমার কাছে ১ লাখ টাকা চেয়েছেন। এইটা কি কোন কথা? এক লাখ টাকা কি কোন কথা হয়? সব কিছুইতো জানেনই আপনি। আপনি ভাই হিসেবে যদি বলেন ...''

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মোঃ সুমনুর রহমান: ''চাইছি, তুমি অনেক বড় প্রোগ্রামার। আরে, ভাই হিসেবে বললে তো টাকার দরকার নাই। তুমি এতো বড় প্রোগ্রামার, শিশা লাউঞ্জ খুলবা, আমি না চাইলে তো এইটা সম্ভব না। তুমি আমার সাথে একটু হাই হ্যালো করবা না? আমিতো তো সরাসরি কোন টাকা চাই নাই।''

(এই সময় তার কাছে আরেকটি ফোন কল আসে)

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মোঃ সুমনুর রহমান: একটা লাইসেন্স নবায়ন করতে ৫ লাখ টাকা লাগে। আমার কথা বলেন,করে দিবে। কিছু খরচপাতি দিয়ে দিয়েন,হয় যাবে....... কাজ হয় যাবে।)

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মোঃ সুমনুর রহমান: ''১১ নম্বরের ফ্লোরের মালিক অনিককে চিন? ... বারের লাইসেন্স হেল্ডআপ করে দিবে আমি নেগেটিভ রিপোর্ট দিলে। ঢাকা শহরে আমি একটা গাটস নিয়া চাকরি করি। গুলশান বনানী এলাকায়, আমি কোন অন্যায়ভাবে কিছুই করিনি, ভালোবাসা দিয়ে করেছি। আমি ডিসটার্ব করলে তুমি কিছুই করতে পারবা না। বার পারমিটের সবকিছু আমার হাতে। আমার রিপোর্ট ছাড়া কোন কাজ হবে না।''

''পার্সোনাল  সম্পর্ক হলো বিশাল ব্যাপার। আমি লা মেরিডিয়ানের পার্টি বন্ধ করে দিছিলাম। আমি যদি বলি আমি এইডা দিমুনা, দিমুনা। তুমি ভাই ব্যবসা কর। ১০ টাকা ব্যবসা করলে আমাকে একটাকা দাও, দুইডা টাকা দাও। তোমাদের ইনকাম টা তো অবৈধ, তাই অন্যরা ডিসটার্ব করবে। তাই খরচ দিয়া দাও। তুমিও ভালো থাকো, আমিও ভালো থাকি।

আমার এই জোনে চলতে হইলে অনেক টাকা খরচ লাগে। আসছি অনেক টাকা পয়সাও খরচ লাগছে। আমি সারা জীবন থাকবো না। আমার দুইটা পয়সার জন্যই তো আসছি। তুমি কি ওসিরে পয়সা দেওয়া ছাড়া ব্যবসা করতে পারতেছ? তাইলে আমিও তো এরকমই।''

''দেখ আমি যদি ডিসটার্ব করি একঘন্টাও তুমি তোমার ব্যাবসা চলে কি না? দুই মাস আগে বনানী ১১ নম্বরে একটাতে গিয়া পার্টি বন্ধ করছিলাম। তোমাদের মিঠু দাদারটা। কেউ কথা বলতেছিল না। পরে আমি বলছি যে, ভাই আমি কারো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে এখানে আসি নাই। আমি দুইমাস ধরে আসছি, আপনারা কেউ আমার সাথে যোগাযোগ করতেছেন না। পরে ওরা নিজেরাই স্বীকার করছে, এটা তো স্বাভাবিক, যে একটা লোক দুইমাস ধরে এখানে আসছে, এই লোক কিছু পয়সা না পাইলে এই লোক তো একটু ডিসটার্ব করবেই। কাউকে মামলা দেই নাই। তাদের ধইরা নিয়া মামলা দিতে পারতাম। মামলা দেই নাই।'' 

''যদিও মিঠুর সাথে আমার ভালো সম্পর্ক। যখন তখন ফোন দিত। সবই সম্পর্ক। আমি তারে বলছি যে, সে আমার ছোট ভাইয়ের মত।''

ইভেন্ট অর্গানাইজার রাইসুল ইসলাম জুয়েল: ''ভাই আমি ও তো যোগাযোগ ঠিকঠাক মতই রাখতাম। আপনার আগের সামসুল কবীর সাহেবকে আমি নিজে গিয়া টাকা দিয়া আসতাম। নিজে অফিসে গিয়া দিয়া আসতাম।''

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মোঃ সুমনুর রহমান: ''আমি কনফার্ম সাত মাস হইছে আইসি। তারপর আমি তোমারে ফোন দিসি, তোমার বিহেভিয়ার আমার ভালো লাগে নাই। তুমি আমারে চার্জ কর,আমার নাম্বার কে দিলো। আমি প্রশাসনের লোক। আমার কাজই হলো এইসব সংগ্রহ করা। বলো কার নাম্বার নিতে হবে, বলো?''

''আগের অফিসাররা গুলশানের রাস্তাঘাট চিনে না। তুমি আমারে কি চিনাইবা?''

''আরে হোটেলে এই যে মদ বেচে, বিদেশ থেকে আনে, পর্যটন থেকে কিনে, এইসব বারের লাইসেন্স দিসে কে? এগুলা সবই হয় আমার পারমিশনে।''

 ''আমাদের কেন এত মূল্যায়নটা? তুমি বুঝো দুইটা লোক ওয়েস্টিনে বইসা রইছে আমারে নিয়া। আমার যদি ওইখানে এন্ট্রান্সটা নাই থাকতো, বা প্রভাবটা না থাকতো, তাহলে আমি কি সেখানে এভাবে থাকতে পারতাম। নারকোটিক্স এর ইন্সপেক্টর ছাড়া এসব জায়গায় কেউ যেতে পারে না।''

 ''রাব পুলিশ ও সেখানে ঢুকতে পারে না। ঢুকলেও সে ওইখানে কিছু করতে পারে না। ফাইসা যাবে।''

 ইভেন্ট অর্গানাইজার রাইসুল ইসলাম জুয়েল: ''হ্যাঁ, হ্যাঁ, একমাত্র নারকোটিক্স-ই ঢুকতে পারে।''

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মোঃ সুমনুর রহমান: ''হ্যাঁ, হ্যাঁ, একমাত্র নারকোটিক্স-ই ঢুকতে পারে। পুলিশ যদি ভিতরে ঢুকতে চাই তাহলে আমারে ফোন দিবে, বলবে আসেন আমরা এই বারে অভিযান করবো। আপনাদের সহযোগিতা চাই। কি মনে করেন নারকোটিক্স ইন্সপেক্টরকে?''

ইভেন্ট অর্গানাইজার রাইসুল ইসলাম জুয়েল: ''এখন আপনি আমার ভাই, আমার ব্যবস্থা আপনি সবসময় করবেন। আমি এইডা আশাবাদী। আপনার কি লাগে আমাকে মুখ ফুইটা বলবেন।''

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মোঃ সুমনুর রহমান: ''ভালোবাসা, ভালোবাসা।''

ইভেন্ট অর্গানাইজার রাইসুল ইসলাম জুয়েল: ''আপনেরে আমি ভালোবাসি। আপনেরে আমি মন থেকে ভালো বাসি, ভাই। আপনি কিন্তু অনেক ইয়াং ভাই। অফিসারগো মত বুইরা না,অনেক ইয়াং। আপনি স্পষ্ট কইরা বলেন, জুয়েল আমাকে ১ লাখ টাকা দাও। লাগবে। আমি দিয়া যাবো আপনাকে। জুয়েল ৫০ হাজার দাও, দাবী কইরা বলবেন, আমি দিয়া যাবো আপনাকে।''

 মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মোঃ সুমনুর রহমান: ''ঠিক আছে, লাগলে আমি বলবো।''

ইভেন্ট অর্গানাইজার রাইসুল ইসলাম জুয়েল: ''লাগলে বলবেন, কিন্তু আরেকজনের ভায়া বলবেন না।''

 মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মোঃ সুমনুর রহমান: ''না না না, শোন। আমি মদ টদ খুব একটা খাই না।''

ইভেন্ট অর্গানাইজার রাইসুল ইসলাম জুয়েল: ''আমিও ভাই।''

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মোঃ সুমনুর রহমান: ''এখন আমি যদি বলি আমি মদ খাবো, ১০ জনে মিলে গিয়ে খাইলেও পুরাই ফ্রি। আমি তোমার পার্টিতে কেন গেছি? ওনলি সম্পর্কটা ফ্রি করতে। তোমার মনেও একটা খোঁচা আছে, আমার মনেও একটা খোঁচা আছে । নিজেদের ভুল বোঝাবুঝির জন্য একটা দূরত্ব তৈরী হইছে। এই দুরত্ব কমানোর জন্যই চলে আসলাম। কত জায়গায় আমাকে ইনভাইট করে।''

ইভেন্ট অর্গানাইজার রাইসুল ইসলাম জুয়েল: ''আপনি যানও না ওইসব জায়গায়, আমি জানি। ভালোবাসছেন দেইখা আসছেন।''

 মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মোঃ সুমনুর রহমান: ''হ, চা খাইতে আসছি, যা এইটা প্রমাণ হোক, আমাদের সম্পর্কটা সহজ। ওকে তাহলে উঠি।''

ইভেন্ট অর্গানাইজার রাইসুল ইসলাম জুয়েল: ''আপনি আমারে ছোট ভাই হিসেবে বলবেন, টাকা লাগলে বলবেন। আমি গিফট দিতে ভালোবাসি।''

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মোঃ সুমনুর রহমান: ''আমিও গিফট নিতে ভালোবাসি।''