ন্যাভিগেশন মেনু

বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারীদের হোতা দালালদের দৌরাত্ম্য থামছে না


দেশে করোনার ভারতীয় ধরণ সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সীমান্তবর্তী অনেক জেলায় লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা জীবননগর এবং দামুড়হুদায় জারি করা হয়েছে লকডাইন। জোরদার করা হয়েছে বিজিবির টহলও।

এরপরও থেমে নেই অনুপ্রবেশ। দালালদের দৌরাত্ম্যে ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুরে এবং চুয়াডাঙ্গার জীবননগর সীমান্ত দিয়ে বেড়েছে ভারত থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ।

অভিযোগ রয়েছে, মোবাইল ফোনে দু’দেশের দালালরা যোগাযোগ করে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে রাতের আঁধারে লোক পারাপার করছে। এমন অবৈধ পারাপার করোনার ভারতীয় ধরণ ছড়ানোর ক্ষেত্রে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

অবৈধভাবে ভারতে যাওয়া বাংলাদেশিদের সঙ্গে দুপাশের’র দালালরা যোগাযোগ রাখে। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে রাতের আঁধারে এপারের দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয় ওপারের দালালরা। তবে সীমান্তে প্রবেশের সময় মাঝে-মধ্যে কিছু মানুষ আটক হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অধরা থেকে যায়।

দালাল চক্রের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, ভারতে অপু ভাই নামে একজন আছেন, তিনি নদীতে নৌকা চালান। তার সঙ্গে কথা হয় হোয়াটসঅ্যাপে। কখনো তাকে দেখিনি। ওপারে তার একটি গোডাউন রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশে প্রবেশকারীদের এনে রাখা হয়। বর্ডারে তার লোক আছে। রাতে সুযোগ বুঝে গ্রুপ  করে তাদের কাছে এসব মানুষদের ছেড়ে দেয়। এপারে (বাংলাদেশ) সাইফুলদা তাদের বুঝে নেয়।

দালাল চক্রের এ সদস্য আরও জানায়, ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় যারা বিজিবির হাতে আটক হয়, তাদের নাম-ঠিকানা ও আইডিকার্ড অপুদা ভারত থেকে আমাদের কাছে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেয়।

আমাদের টাকা পাঠায় বিকাশের মাধ্যমে। এরপর আমরা তাদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা করি। বাংলাদেশ থেকে সাইফুলদা যাদের পাঠায় ভারতে অপুদা বুঝে নেন। এ কাজে একাধিক চক্র আছে।

এদিকে ৫৮ বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৯শ’ জনকে আটক করেছে  বিজিবি। যাদের বিরুদ্ধে সীমান্তবর্তী মহেশপুর থানায় ও জীবননগর থানায় পাসপোর্ট আইনে ১৪৯ টি মামলা দেয়া হয়েছে।

গত  ২৬ এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ভারত থেকে বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ বেড়েছে। ১০ মে থেকে এখন পর্যন্ত অবৈধভাবে ভারত থেকে অনুপ্রবেশের সময় বিজিবির হাতে আটক হয়েছেন ৬৫ জন। এসব অবৈধ অনুপ্রবেশের ফলে সীমান্ত এলাকাসহ দেশে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।

ঝিনাইদহ জেলায় ভারতীয় সীমান্ত এলাকা রয়েছে ৭০ কিলোমিটার এবং চুয়াডাঙ্গায় রয়েছে ১৪৭ কিলোমিটার। এসব এলাকা দিয়ে প্রায়ই অবৈধভাবে মানুষ যাতায়াত করে। বিশেষ করে রাতের আঁধারে বেশি যাতায়াত হয় বলে স্থানীয় বাসিন্দা, বিজিবি ও পুলিশ জানিয়েছে।

এসব এলাকায় ৫৮-বিজিবির ১০টি বিওপি ক্যাম্প রয়েছে। এগুলো হলো- যাদবপুর, মাটিলা, সামান্তা, পলিয়ানপুর, বাঘাডাঙ্গা, খোসালপুর, লড়াইঘাট, বেনিপুর, কুসুমপুর ও শ্রীনাথপুর। ৫৮-বিজিবির আওতাধীন আরও নয়টি বিওপি ক্যাম্প রয়েছে, যা পার্শ্ববর্তী জেলা চুয়াডাঙ্গার মধ্যে পড়েছে।

সীমান্তের মাটিলা গ্রামে বসবাসকারী নুরুন নবী জানান, সীমান্তের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে ভারত থেকে লোক আসে। তারা সীমানা অতিক্রম করে বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নেয়। একইভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যায়। এরা মূলত একশ্রেণির দালালের মাধ্যমে এপার ওপার গিয়ে থাকে। যাদের কাছে কোনো দেশেরই পাসপোর্ট বা ভিসা নেই।

ভারতের নাগরিক সত্যচরণ সরকার। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কোলঘেঁষা গ্রাম কাশিপুর গ্রামের বাসিন্দা। এ গ্রামটি ভারতে উত্তর ২৪ পরগোনার বাগদা এলাকায়। সত্যচরণ কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করে প্রতিদিনই কৃষিকাজ করতে আসেন। তিনি বলেন, বহুকাল ধরেই আমরা (উভয় দেশের নাগরিক) পাশাপাশি জমিতে কৃষিকাজ করে আসছি। সম্পর্কের খাতিরে আমরা প্রতিবেশী বাংলাদেশিদের বাড়ি যাই।

তারাও আমাদের বাড়ি আসে। কিন্তু ভারতে করোনার মহামারি দেখা দেয়ার পর বিজিবি ভারত বাংলাদেশের সীমানা রেখা পার হতে নিষেধ করেছে। যে কারণে পাশাপাশি জমিতে কাজ করলেও আমরা বাংলাদেশের মাটিতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।

বিজিবির হাতে আটক কয়েকজন অনুপ্রবেশকারী জানায়, গুজরাট থেকে একজন বলেছিল দালালের কথা। তার মাধ্যমে বর্ডারে এলে সেই রাতেই বর্ডার পার করিয়ে দেয়ার কথা। সারাদিন তারা গাড়িতে ঘুরিয়েছে অনেক জায়গায়। রাত আড়াইটার দিকে পার হয়েছিল। ভারত থেকে দালালরা আমাদের মহেশপুরের দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। কিন্তু তারা তাদের নাম বলে না।

অনুপ্রবেশের বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিবির হাতে আটক দালাল ঝিনাইদহ মহেশপুরের হাদিসুর রহমান জানায়, আমি কোনো কিছু জানি না। ওপারে যোগাযোগ হয় মেইন মেইন মানুষের সঙ্গে।

বেনাপোলের লোক আছে ওদের সঙ্গে তাদের সব যোগাযোগ হয়। ওখান থেকে গাড়িতে তুলে ফোন দিয়ে বলে দেয়, একটা গাড়ি যাচ্ছে। তাদের অন্য আরেকটা গাড়িতে তুলে দিও। আমি তাদের অন্য একটা গাড়িতে তুলে দিতাম।

তিনি আরও বলে, বেনাপোলের থেকে রাজু জহুরুর, ছালাম আর মহেশপুরের কিতাব, আশা, হান্নানসহ আরও অনেকে জড়িত এ কাজের সঙ্গে।

ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার ভারতীয় সীমান্তের যাদবপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এবিএম শাহীদুল ইসলাম বলেন, ভারত থেকে এখন আমাদের দেশে কেউ প্রবেশ করা মানে বিপদ ডেকে আনা। অবৈধ যাতায়াত ঠেকাতে হলে সীমান্তে বসবাসকারী স্থানীয়দের সহযোগিতা দরকার।

ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল কর্মকর্তা ডা. মিথিলা ইসলাম বলেন, অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা যারা ধরা পড়ছে তাদের আমরা কোয়ারেন্টাইনে রাখছি। যারা ধরা পড়ছে না তাদের ব্যাপারে আরও বেশি তৎপর হাওয়া প্রয়োজন। কারণ এদের মধ্যে যারা করোনা পজিটিভ হবেন, তাদের থেকে ভারতীয় ধরণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ঝিনাইদহ মহেশপুর-৫৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের পরিচালক লে. কর্নেল কামরুল আহসান বলেন, সীমান্তে বিজিবি টহল জোরদার করা হয়েছে। অবৈধ পথে কেউ যেন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে এজন্য সীমান্তে বসবাসকারীদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও সীমান্ত অতিক্রম না করার জন্য বলা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সীমান্তে টহলের জন্য আমাদের কোনো পথ নেই। মাঠ-ঘাট বাগান দিয়ে আমাদের নজরদারি করতে হয়। এছাড়া আমাদের তেমন কোনো যানবাহনও নেই। ফলে সাইকেল চালিয়ে মেঠো পথেই আমাদের সদস্যরা সীমান্ত পাহারা দিচ্ছেন, যা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মজিবর রহমান এবং চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশানক নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, মহেশপুর সীমান্ত এলাকা এবং জীবননগর ও দামুড়হুদা সীমান্ত এলাকার জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে মিটিং করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদেরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তারা মিটিং করেছেন এবং সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে মানুষকে আনা নেয়ার কাজে কেউ যেন সহযোগিতা না করে। আমরা এর সুফল পাচ্ছি।

এ সীমান্ত এলাকা দিয়ে একদিনে সর্বচ্চ ২৮ জন পর্যন্ত এসেছে। এরপর প্রশাসন কঠোর অবস্থান নেয়ায় এখন আর সেভাবে আসছে না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বিজিবি যেভাবে কাজ করছে তাতে আমরা আশা করছি এ সীমান্ত দিয়ে সেভাবে কেউ প্রবেশ করছে না। প্রবেশ যদি করে তাহলে তাদের আমরা আইনের আওতায় এনে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন পাঠাচ্ছি।

এসকে/সিবি / এস এস