ন্যাভিগেশন মেনু

অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে চীনের বিস্ময়কর অর্জন ও প্রসঙ্গকথা


বেইজিং থেকে আলিমুল হক

২০১৯ সালে গোটা চীন পালন করল ‘নয়াচীন’ তথা গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ৭০তম বার্ষির্কী। বিগত ৭০ বছরে চীনে বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে; পরিবর্তন ঘটেছে বলতে গেলে সকল ক্ষেত্রে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে চীন অর্জন করেছে অভূতপূর্ব উন্নয়ন। একটি দুর্বল, গরীব ও পশ্চাৎপদ কৃষিভিত্তিক দেশ থেকে চীনের বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়াকে অনেকে ‘অলৌকিক ঘটনা’ বলতেও দ্বিধা করছেন না। এই অর্জন সম্ভব হয়েছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)-র সঠিক নেতৃত্ব ও চীনা জনগণের কঠোর পরিশ্রমের ফলে।

বিগত ৭০ বছরে চীন অর্থনৈতিক উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় মোটাদাগে দুটি পর্যায় অতিক্রম করেছে। প্রথম পর্যায়টি ১৯৪৯ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত। দ্বিতীয় পর্যায়টি শুরু হয় ১৯৭৮ সালের শেষের দিকে এবং সে-পর্যায় এখনও চলছে। প্রথম পর্যায়ে, মানে ১৯৪৯ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত, চীন পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালায়। তখন চীনের লক্ষ্য ছিল শিল্পায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করা। কিন্তু এ পথ চীনের মানুষের জন্য অর্থনৈতিক মুক্তি আনতে ব্যর্থ হয়। এরই প্রেক্ষাপটে, ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে, তত্কালীন চীনা নেতা তেং সিয়াও পিং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের নীতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। তখন থেকেই চীন সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি অনুসরণ করতে শুরু করে এবং বিশ্বের সামনে নিজেকে উন্মুক্ত করার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সামনে এগুতে থাকে। সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি চীনকে বদলে দেয় আমুল। চীন নতুন ব্যবস্থায় যে-অগ্রগতি অর্জন করে, তা মানবেতিহাসে বিরল। প্রায় তিন দশক ধরে চীনের অর্থনীতি বছরে গড়ে ১০ শতাংশ হারে বেড়েছে। এর ফলে চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। বর্তমানে চীন নতুন একটি পর্যায় অতিক্রম করছে। এখন চীন দ্রুতগতির প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরিবর্তে, উচ্চমানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগুচ্ছে। চীন এখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন নতুন চালিকাশক্তির সন্ধানেও আছে।

পরিকল্পিত অর্থনীতি পর্যায়ে চীন মূলত উন্নয়নের সোভিয়েত মডেল অনুসরণ করেছিল। তখন চীনের লক্ষ্য ছিল ভারী শিল্প গড়ে তোলা এবং এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা। এই মডেল একটি উন্নয়নশীল দেশকে দ্রুত আধুনিক শিল্প-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করতে সক্ষম হলেও, এর অনেক সীমাবদ্ধতাও আছে।  চীনও এই মডেল অনুসরণ করে তুলনামূলকভাবে সম্পূর্ণ আধুনিক শিল্প-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু এই ব্যবস্থা চীনের তুলনামূলকভাবে নিম্ন মাথাপিছু আয়ের সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। ফলে, জনগণের জীবনমান অনুন্নতই থেকে যায়।

এমনই এক প্রেক্ষাপটে, ১৯৭৮ সালের শেষের দিকে, বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে চীন পরিকল্পিত অর্থনীতি থেকে বাজার অর্থনীতির দেশে রূপান্তরিত হবার পথে পা রাখে। সেসময় বিশ্বে নিওলিবারেল ডিভালেপমেন্ট থিওরি প্রচলিত ছিল। কিন্তু চীনের নেতৃবৃন্দ সেই থিওরি গ্রহণ করেননি। তারা দেশের অর্থনীতি উন্নয়নে সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের নীতি গ্রহণ করেন। এ নীতির আওতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা গড়ে তোলা হয় এবং সেসব অঞ্চলের প্রাধান্য কাজে লাগানো শুরু হয়। পাশাপাশি, ব্যবসা-পরিবেশ উন্নয়নের দিকেও নজর দেয় সরকার।

বিংশ শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকেও বিশ্বে নিওলিবারেলিজম বহাল তবিয়তে ছিল। নিওলিবারেল অর্থনীতিবিদরা ‘শক থেরাপি’র পক্ষে ছিলেন। তাদের মতে, একমাত্র এই থেরাপির মাধ্যমেই একটি পরিকল্পিত অর্থনীতিকে বাজার-অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করা সম্ভব। তাদের কেউ কেউ বলতে থাকেন যে, চীনের গৃহীত বিশেষ অর্থনৈতিক-পদ্ধতি, যাতে সরকার ও বাজার—উভয়ের ভূমিকা আছে, দেশটির জন্য আরও বেশি সমস্যা ডেকে আনবে। কিন্তু, তাদের সে-ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। চীন বিগত চার দশক ধরে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি অনুসরণ করে আসছে এবং দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে গেছে। এক্ষেত্রে চীন যা অর্জন করেছে, তা অর্জন করতে উন্নত দেশগুলোর লেগেছে শত শত বছর। চীনের এই অর্জন ছিল অভূতপূর্ব, বিশ্ব-কাঁপানো। গোটা সময়কাল ধরে চীন সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ গভীর থেকে গভীরতর করার নীতিও অনুসরণ করে গেছে। 

এরই ধারাবাহিকতায়, ২০১৩ সালে অষ্টাদশ সিপিসি কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ সভায় সংস্কার-প্রক্রিয়া সার্বিকভাবে গভীরতর করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এতে সম্পদের বণ্টনের ক্ষেত্রে বাজারের ভূমিকা বাড়ানো এবং সরকারের ভূমিকা উন্নত করার কথা বলা হয়। ঊনবিংশ সিপিসি জাতীয় কংগ্রেসের রিপোর্টেও জোর দিয়ে বলা হয় যে, সম্পদের বণ্টনের ক্ষেত্রে বাজারকে নিষ্পত্তিমূলক ভূমিকা পালন করতে দিতে হবে এবং সরকারের ভূমিকাও উন্নত করতে হবে।

বর্তমানে চীন তথা বিশ্ব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চীনের সামনে উন্নয়নের সুযোগ যেমন এন্তার, তেমনি চ্যালেঞ্জও অনেক। চীনের অর্থনীতি বর্তমানে ‘নিউ নর্মাল’ বা ‘নতুন স্বাভাবিক’ অবস্থায় প্রবেশ করেছে। এ অবস্থায় ‘কার্যকর বাজার’ ও ‘দায়িত্বশীল সরকার’-কে পূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দিতে হবে। এ কথা সত্য যে, চীনের অর্থনীতি বর্তমানে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। কিন্তু এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে, ২০২০ সালের মধ্যে সার্বিকভাবে সচ্ছল সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য বাস্তবায়নে চীন সক্ষম হবে বলেই সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন। এসব বিশ্লেষকের মধ্যে যেমন চীনারা আছেন, তেমনি আছেন বিদেশিরাও।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে: উন্নয়নশীল দেশগুলো কি উন্নয়নের চীনা মডেল অনুসরণ করতে পারে? বর্তমানে উন্নয়নের যেসব তত্ত্ব ও মডেল প্রচলিত আছে, সেগুলো সবই উন্নত দেশগুলোতে সৃষ্ট। কোনো কোনো উন্নয়নশীল দেশ সেসবের ভিত্তিতে নিজস্ব উন্নয়ন ও সংস্কার নীতিমালা গ্রহণ করেছে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোর অধিকাংশই উন্নত বিশ্বের মডেল অনুসরণ করে নিজেদের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। উল্টো কোনো কোনো দেশের সমস্যা বেড়েছে। দৃশ্যত, তাদের সকল নীতি উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতিকেই বেশি পুষ্টি যুগিয়েছে। এ অবস্থায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ‘চীনা মডেল’ হতে পারে পরীক্ষিত বিকল্প।

১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হবার পর, ৩০ বছর ধরে চীন অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশ কর্তৃক গৃহীত উন্নয়নের পথই মূলত অনুসরণ করে আসছিল। কিন্তু সে-পথ চীনের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়। অথচ সংস্কার ও উন্মুককরণের নীতি তথা সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি গ্রহণের পর, বিগত ৪০ বছরে চীন অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জনে সক্ষম হয়। মানবেতিহাসে এতো অল্প সময়ে এতো বেশি উন্নয়ন অর্জনের উদাহরণ নেই। এই উন্নয়নকে আধুনিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না; চীনের অর্জনকে ব্যাখ্যা করতে এখন নতুন তত্ত্ব প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

চীন এখনও উন্নয়নশীল দেশই রয়ে গেছে। ফলে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে চীনের মিলমিশ এখনও স্পষ্ট। এ অবস্থায় উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নয়নের ‘চীনা মডেল’ বা ‘চীনা তত্ত্ব’ ব্যবহার করতে পারে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য উন্নয়নের ‘চীনা মডেল’, উন্নত বিশ্বে সৃষ্ট মডেল বা তত্ত্বের চেয়ে অধিক কার্যকর প্রমাণিত হবে, এমনটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে।

[লেখক: বার্তা সম্পাদক, চীন আন্তর্জাতিক বেতার]

এস এস