হাবিবুল্লাহ মিজান/ বিশেষ প্রতিবেদক
অবশেষে রাজধানীর ভাটারা এলাকায় গৃহপরিচারিকা আয়েশা ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের রহস্য উম্মোচন করতে পেরেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
রবিবার সকালে বাংলাদেশ পোস্টের সাথে আলাপচারিতায় ডিবি পুলিশের এডিসি মো সাজাহান সাজু বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানিয়েছেন, ডিবি পুলিশের গুলশান জোনাল টিম লিডার এডিসি মোঃ গোলাম সাকলায়েন অভিযান চালিয়ে খুনি নাজমুলকে রাজধানীর সায়েদাবাদ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে শনিবার রাতে।
অভিযানটি চালানো হয় গোয়েন্দা (উত্তর) বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমানের নির্দেশনায়। আর এডিসি মোঃ শাহজাহানের তত্ত্বাবধানে এডিসি মোঃ গোলাম সাকলায়েন নেতৃত্বে গুলশান জোনাল টিম অভিযান পরিচালিত হয়।
এডিসি মোঃ গোলাম সাকলায়েন বলেন, আমরা হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত চেতনানাশক ওষুধ, মোবাইল সিম কার্ড, জিআই তারসহ মূল হোতা নাজমুলকে গ্রেফতার করেছি।“
নিহত আয়েশার বয়স ২৮/২৯। ঘরে বারো বছরের এক ছেলে ও আট বছরের এক কন্যা। হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে আয়েশার এক যুগের সংসার ভেঙ্গে যায় বছর দুই আগে।
স্বামী ট্রাক ড্রাইভার দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে থাকে টাংগাইলে। আয়েশা দুই সন্তানকে নিয়ে গৃহপরিচারিকার কাজ করে সংসার নির্বাহ করতো। থাকতো ভাটারা এলাকায় সাধারণ একটি ভাড়া বাড়ীতে।
স্বামীকে নিয়ে ফের সংসার গড়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে আয়েশা। প্রতিবেশী নাজমুল পেশায় কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিল প্রাইভেট গাড়ীচালক। বর্তমানে ইয়াবা ব্যবসায়ী।
এরই সুযোগ নেয় নাজমুল। আয়েশার সাথে আস্থার সম্পর্ক তৈরী করে। আয়েশাকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, এক কবিরাজের বাণ মারার কারণেই তার স্বামী জসিম দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। আর আয়েশাকে ছেড়ে দ্বিতীয় বউ নিয়ে অন্যত্র বসবাস করে। এমনকি নিজের ছেলে মেয়েদের ওপরেও নেই কোন টান।
এরকম অবস্থা থেকে কিভাবে বাঁচা যায়, কিভাবে ফেরৎ পাওয়া যাবে স্বামীকে, ছেলেমেয়েরা কিভাবে পাবে তাদের বাবার আদর-ভালোবাসা?
এই প্রশ্ন গুলোর পেছনের হতাশায় সব হারিয়ে ফেলে আয়েশা। এমনকি তার নিজের জীবনও। ঘটনার দিন রাত ১০টায় আয়েশা নাজমুলকে ফোন দেয়।
রাত ১টা ২৫ মিনিটে আয়েশার সাথে কথা হয় নাজমুলের। কথামত নাজমুল আয়েশার বাসায় যায়। রাত দেড়টার দিকে আয়েশার বাসায় ঢোকে। তার রুমে একটি খাট আছে। খাটের উপর ছোট ছেলে ঘুমিয়ে ছিল।
আয়েশা তার স্বামীকে বশে আনার উদ্দেশ্যে নাজমুলের কথামতো ২৪০০ টাকা দেয়। নাজমুলকে বশে আনার কথা বলে আয়েশার সাথে যৌনমিলনও করে।
এরমধ্যেই আয়েশার স্বামী জসিম উদ্দিন টাংগাইল থেকে ঢাকায় এসে তার বোনের বাসায় ওঠে ছোট বউকে সাথে করে। সুযোগ নেয় নাজমুল।
আয়েশাকে বুঝাতে চেষ্টা করে যে, কবিরাজের মাধ্যমেই এটি সম্ভব হয়েছে। চলতি মাসের ৪ তারিখ রাতে আয়েশা তার স্বামীকে কাছে এনে দিতে বললে দু’জনের মধ্যে ঝগড়া হয়।
তখন আয়েশা নাজমুলকে বলে- ‘আমার টাকা নিয়েছেন, আমার চরিত্র নষ্ট করেছেন, এখন আমার স্বামীও আসল না, তাহলে আমার টাকা ফেরত দেন নইলে ভাল হবেনা।
দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় নাজমুল। তাই পকেটে করে ঘুমের ওষুধ নিয়ে আয়েশার ঘরে গিয়ে তাকে বুঝায় যে আয়েশাকে “বাঁধা বান ” মেরেছে তার ছোট সতীন হামিদা।
তাই কবিরাজ ওষুধ দিয়েছে আয়েশাকে খেতে হবে। বলে পানির বোতলে অল্প একটু পানির মধ্যে ওষুধ গুলিয়ে খাইয়ে দিয়ে যৌনমিলন করে। তাকে বুঝায় যে এটা কবিরাজের নির্দেশ।
এরপর নাজমুল আয়েশাকে জানায় তাকে “বাঁধা বান” মারা হয়েছে তাই তাকে হাত পা বেঁধে নাজমুলের সাথে যৌন মিলন করতে হবে। নাজমুলের কথা মত আয়েশার হাত-পা বাধা হয়।
এর মধ্যে ওষুধের ক্রিয়ায় সে অচেতন হয়ে পড়ে। নাজমুল তখন তার সাথে নিয়ে যাওয়া জিআই তার দিয়ে আয়েশার গলায় পেঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। তখন বিছানায় ঘুমন্ত ছোট ছেলে।
এরপর এ হত্যাকান্ডের রহস্য উম্মোচনে কাজ শুরু করে গোয়েন্দা উত্তর বিভাগ। এদিকে নিহতের পরিবার আয়েশার স্বামী ও সতীনসহ অজ্ঞাতদের আসামী করে মামলা রুজু করে ভাটারা থানায়।
কিন্তু ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় গোয়েন্দাদের নিরলস পরিশ্রম বৃথা যায়নি। গ্রেফতার হয় কথিত কবিরাজ, ধর্ষক-হত্যাকারী নাজমুল।
গতকাল শনিবার (২০ জুলাই) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সায়েদাবাদ এলাকা থেকে গ্রেফতার হয় নাজমুল। তাকে নিয়ে পরিচালিত অভিযানে উদ্ধার হয় ঘুমের ওষুধ, জিআই তার ও ভিকটিমের ব্যবহৃত সিম কার্ড। বের হয়ে আসে হত্যাকান্ডের চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
এসএস