ন্যাভিগেশন মেনু

কলকাতায় হাফ বয়সী বিবিকে নিয়ে সুখেই ছিল বঙ্গবন্ধুর খুনি মাজেদ


গত ১২ এপ্রিল, শনিবার ফাঁসিতে ঝোলানো হলো ইতিহাসের ঘৃণ্যতম খুনীদের একজন আবদুল মাজেদকে।  ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ ৪৫ বছর বিলাসী জীবন কাটিয়েছে এই খুনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকাণ্ডের পরবর্তীতে বন্দুকের নলে ভর করে ক্ষমতায় আসা জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের জন্য মাজেদকে পুরস্কৃত করেছিল। দেশে বিদেশে সে রাষ্ট্রের বড় বড় পদে আসীন হয়েছিল জিয়ার বদৌলতে।

কিন্তু ১৯৯৬ সালে জাতির পিতার আদর্শের দল ক্ষমতায় আসার পর আর তার ভাগ্য সহায় হয়নি। পালাতে হয় দেশ ছেড়ে।

পালিয়ে দেশের বাইরে থাকলেও রক্তচোষা এই খুনীর লালসা ছিল নারীতে! জীবনের দীর্ঘ সময় বিদেশে থাকলেও ঢাকায় থাকা চার সন্তানের মা সালেহা বেগমকে বিদেশে নিয়ে বসতি গড়েনি। যেখানে গিয়েছেন নিজের মতো করে জোগার করে নিয়েছেন শয্যাসঙ্গী! সবশেষ ভারতের কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের বেডফোর্ড লেনে বসতি গড়ে মাজেদ। সেখানে একটি ভাড়া বাড়িতে প্রায় ২০ বছর ধরে নাম পরিচয় গোপন করে বসবাস করেছে আহমেদ আলি নামে। সেখানে সুদের ব্যবসা ও টিউশনি করে জীবন চালাতো সে।

কলকাতায় খুনি মাজেদ তথা আহমেদ আলি বাস করতো ভারতীয় হিসেবেই। তার ছিল আধার কার্ড, ভোটার আইডি কার্ড, রেশন কার্ড ও ভারতীয় পাসপোর্ট। সেই সঙ্গে কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের BPL (Below Proverty Line) তালিকায় ছিল তার নাম! BPL তালিকায় যাদের নাম থাকে তারা দরিদ্রসীমার নিচে থাকা পরিবার। সেইসব পরিবার সরকারের কাছ থেকে পায় আর্থিক সুবিধা! যেখানে খোদ ভারতীয় নাগরিককেরাও সেই তালিকায় নাম ওঠাতে পারেন না, সেই তালিকায় বাংলাদেশি এক দুর্ধর্ষ খুনির নাম রয়েছে, সেটা ভাবা যায়! নিশ্চয়ই সেখানেও ছিল তার খুঁটির জোর। 

কলকাতায় বাংলাদেশি দুর্ধর্ষ অপরাধীদের ডেরার কথা নতুন নয়। এর আগেও বহু কুখ্যাত অপরাধী আস্তানা গেড়েছে এই পশ্চিমবঙ্গে। যেখানে খোদ ভারতীয়রা পাসপোর্ট করতে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশের নাগরিক ও বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি বরখাস্ত ক্যাপ্টেন মাজেদ আসল পরিচয় গোপন করে ভারতীয় হিসেবে আহমেদ আলি নামে পাসপোর্ট পেয়ে যান, সেটা শুধু বিস্ময়েরই নয়, অবিশ্বাস্যও বটে! 

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তিনি সেই বিস্ময়কর ও অবিশ্বাস্য কাজ নিজে করে দেখিয়েছেন!  পাসপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশনের কাজটি যে কতো জটিল, সেটি শুধু ভারতীয়রাই জানেন! 

এটা নিশ্চিত যে, এখানে এক কিংবা একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির সান্নিধ্যে ছিল খুনি মাজেদ! নইলে সব কাগজপত্র তৈরি করে একজন খুনির ভারতীয় বনে যাওয়া অসম্ভব! কে বা কারা সেই প্রভাবশালী ব্যক্তি, সেটি হয়তো এখনই জানা যাচ্ছে না।তবে  সময় একদিন সব সত্যকে সামনে নিয়ে আসবে।

আব্দুল মাজেদ ২০১১ সালে তার থেকে ৩২ বছরের ছোট উলুবেড়িয়ার সেলিনা বেগমকে বিয়ে করে। তাদের ছয় বছরের এক মেয়েও আছে। কিন্তু তার অপকর্মের কথা জানতো না সেলিনা। জানতো না যে তার বাংলাদেশে রয়েছে স্ত্রী ও চার সন্তান। সেলিনার সঙ্গে খুনি মেজাজ দেখালেও সে বুঝতে পারেনি তার চরিত্র। অন্যদিকে ঢাকায় তার স্ত্রী সালেহা খাতুনও জানে না তার স্বামীর রয়েছে তারই মেয়েসম স্ত্রী। যাকে নিয়ে কলকাতায় আয়েশ করছে মাজেদ। কৌশলে দু’পাশে দুই স্ত্রীকে ম্যানেজ করেই চলছিল তার জীবন।

মাজেদের স্ত্রী সেলিনা ওরফে জরিনা বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে, ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে চলতো মাজেদ। এমনকী খেতে দিতে সামান্য দেরি হলেও রেগে আগুন হয়ে যেতো সে। কিন্তু এটা যে তার খুনী মেজাজ সেটা সেলিনা বুঝতে পেরেছে অনেক পর। ততক্ষণে ঝুলে গেছে সব।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি কলকাতার পিজি হাসপাতাল থেকে রিপোর্ট আনতে বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফেরেনি মাজেদ। গোপনে চলে এসছিল ঢাকায় পুরনো বিবির সঙ্গে সময় কাটাতে! সে টের পেয়েছিল কলকাতায় তার দিন শেষ। পিছু লেগেছে গোয়েন্দারা।

এদিকে কলকাতায় মাজেদের ছোট বিবি সেলিনা বেগম ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে পার্ক স্ট্রিট থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন। এরপর পার্ক স্ট্রিট থানা পিজি হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ ঘেঁটেও মাজেদের খোঁজ পায়নি। তবে পুলিশ মাজেদের ভাড়া বাড়িতে একটি ব্যাগ পায়। সেই ব্যাগে খোজ মেলে বাংলাদেশের দুটি ফোন নম্বর- +৮৮০১৫৫২৩৮৭৯১৩ এবং +৮৮০১৭১১১৮৬২৩৯।

সম্ভবত এই ফোনেই নিয়মিত কথা বলতো ঢাকায় তার পরিবারের সঙ্গে। আর তার জেরেই নাকি গোয়েন্দাদের জালে আসে মাজেদ।

ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বাটামারা গ্রামের মরহুম আলী মিয়া চৌধুরীর ছেলে ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদের প্রথম স্ত্রী ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট আবাসিক এলাকায় বসবাস করছেন। আবদুল মাজেদের রয়েছে ৪ মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে মোট ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত। এর মধ্যে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মুহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

এ ছাড়া এসএইচএমবি নূর চৌধুরী, এএম রাশেদ চৌধুরী, খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম ও মোসলেম উদ্দিন এখনও সরকারি খাতায় ফেরার। 

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরেক আসামি আজিজ পাশা ২০০২ সালে পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা যায়।

এডিবি/এস এস