ন্যাভিগেশন মেনু

পাকিস্তানের শৃঙ্খল ভেঙ্গে বাঙালীজাতির মুক্তির দিন আজ


আজ ২৬ মার্চ। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। পাকিস্তানের শৃঙ্খল ভেঙ্গে বাঙালীজাতির শৃঙ্খল মুক্তির দিন আজ। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা ওড়ানোর দিন। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালের এই দিনে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ মধ্যরাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।

বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই শুরু হয়েছিল একাত্তরের আজকের এই দিনে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মহার্ঘ স্বাধীনতা।  বাংলাদেশের স্বাধীকার আদায়ের দৃঢ় মনোবল নিয়ে পশুশক্তিকে পরাজিত করে ঘোর অন্ধকার-অমানিশা কাটিয়ে বাংলার চিরসবুজ জমিনে রক্তে রাঙানো লাল-সবুজ পতাকার ভ্রূণ জন্ম নেয় আজকের ঐতিহাসিক দিনটিতেই।

দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দু’শ বছরের ব্রিটিশ-বেনিয়া শাসনের অবসানের পর ২৪ বছর ধরে চলে বিজাতীয় ভাষা, গোষ্ঠীর শাসন ও শোষণ।

বিশ্বের বুকে স্বাধীন দেশের অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল বীর বাঙালি। হানাদার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল বাঙালী জাতি। জীবন দিয়েছিলেন ৩০ লাখ বাঙালী। আর ১০ লাখ মা-বোনকে ইজ্জত হারাতে হয়েছিল স্বাধীনতার জন্য।

 রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সূচনার গৌরব ও অহঙ্কারের দৃপ্ত শপথের দিন আজ। ২৫ মার্চ পাকিস্তান হায়নাদের কথিত ‘সার্চলাইট’-এর ভয়াল ‘কালরাত্রিতে লাশের সারি আর জননীর কান্না নিয়ে রক্তে রাঙা নতুন সূর্য উঠেছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। ভীতবিহ্বল মানুষ দেখল লাশপোড়া ভোর। সারি সারি স্বজনের মৃতদেহ। আকাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া। রক্তচোষা পাকিস্তানি হায়েনাদের পৈশাচিক হামলায় ২৫ মার্চ রাতে লাখ নিরস্ত্র বাঙালী প্রাণ হারিয়েছিল। কিন্তু দমে যাবার পাত্র নয় বীর বাঙালী।

এমন পৈশাচিক কাণ্ডে বাঙলার মানুষের চোখে জল এলেও বুকে জ্বলে উঠেছিল প্রতিরোধ-প্রতিশোধের তীব্র আগুন। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জ্বলে উঠল মুক্তিকামী মানুষের রোষ। হাতে তুলে নিল অস্ত্র। গড়ে তুললো চরম  প্রতিরোধ। মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে ‘জয় বাংলা’ তীব্র স্লোগান তুলে ট্যাংকের সামনে এগিয়ে দিল সাহসী বুক। 

আজ থেকে ৫০ বছর আগে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

শত্রুসেনাদের বিতাড়িত করতে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করার বঙ্গবন্ধুর ডাকে জীবনপণ সশস্ত্র লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বীর বাঙালি।  ঘোরতর ওই অমানিশা ভেদ করেই দেশের আকাশে উদিত হয় স্বাধীনতার চিরভাস্বর সূর্য।

এ পরাধীনতার শৃংখল ভেঙে আজকের দিনে মুক্তিকামী মানুষের অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ও নির্দেশে বাংলার মানুষের স্বপ্ন-সাধ ও কাঙ্খিত স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ সূচনা ঘটে।

বাঙালী জাতি জীবনবাজি রেখে হানাদার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে  মরণপণ লড়াই-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ’৪৭-এ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভক্তির পর থেকেই উর্দু শাসকদের নানা কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বাঙালির রক্ত সংগ্রামের চেতনার উন্মেষ ঘটতে থাকে।

মাতৃভাষার দাবিতে সেই ’৪৮ সাল থেকে শুরু করে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তদান সংগ্রাম-আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে রায়, ’৫৬-তে এসে সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বীকৃতি আদায়, ’৬২-এর শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬ দফার মধ্য দিয়ে বাঙালির মুক্তিসনদ ঘোষণা, ৬৯-এর ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের বিদায় এবং ’৭০-এ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরংকুশ বিজয়ের ধারাবাহিকতায়ই এসেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব স্বপ্নের স্বাধীনতা। 

১৯৭০ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এ জগদ্বিখ্যাত ঘোষণার মধ্য দিয়েই মূলত বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে যায়। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ আজ ইউনেরস্কার ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণেই দামাল ছেলেরা খুঁজে পায় গেরিলা যুদ্ধের গোপন কৌশল ও করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা। তারপরও ২৫ মার্চ মধ্যরাতে গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধুর ইপিআর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর জাতিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

সমগ্র জাতি দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান বুকে ধারণ করে আত্মশক্তিতে বিশ্বাস স্থাপনের মধ্য দিয়ে মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। 

মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিপাগল বাঙালির রক্তের বন্যায় ভেসে যায় পাকিস্তানের দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হানাদার বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ, জ্বালাও-পোড়াও অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’।

প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয় এবং মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দান, রাশিয়ার অস্ত্র সরবরাহ ও কূটনৈতিক সমর্থন, সমগ্র মুক্তিকামী বিশ্ব ও জনতার অকুণ্ঠ সমর্থন এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধেই পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নেয় আরও বাঙালীর অতি প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।

স্বাধীনতার স্মৃতিবিজড়িত দিনটিতে সমগ্র জাতি আজ বাঁধভাঙা প্রাণের উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত হবে। ফুলে ফুলে ভরে উঠবে জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ দেশের সব স্মৃতির মিনার। হৃদয়পটে সৃষ্ট গভীর ক্ষত থেকে ভেসে উঠবে ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’- এ পঙ্কতিমালার মর্মার্থ।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১২টায় খবর আসে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পিলখানা, রাজারবাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ শহরের বিভিন্ন স্থানে হামলা করেছে। রাত পৌনে ১টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণা দিয়ে তার বাসভবনেই অবস্থান করতে থাকেন।

পাক সামরিক জান্তা সরকারের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রাস্তার ব্যারিকেড সরিয়ে কর্নেল জহিরের নেতৃত্বে একটি কমান্ডো প্লাটুন বঙ্গবন্ধুর ঢাকার ধানমণ্ডি বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এরই মধ্যে ক্যাপ্টেন হুমায়ুন বঙ্গবন্ধু ভবনের দেয়ালের চারদিকে অবস্থান নেয়।

পাকিস্তানি  মেজর বিলাল বঙ্গবন্ধু ভবনের দোতলার একটি বন্ধ ঘরের দরজা ভেঙে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। তারা বঙ্গবন্ধুকে ট্যাংক-কামানসহ কড়া পাহারায় শের-ই-বাংলা নগরের সামরিক সদর দফতরে নিয়ে যায়। পরে তাকে নেয়া হয় ক্যান্টনমেন্টের সেনাবাহিনীর অফিসার্স মেসে।

টিক্কা খানের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুকে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের একটি কক্ষে নিয়ে আটকে রাখা হয়। সেখান থেকেই পরদিন নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানে।

বঙ্গবন্ধুর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণাটি চট্টগ্রামে নোঙর করা একটি বিদেশী জাহাজের সেটেও ধরা পড়ে। শুনতে পান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জনসংযোগ শাখার প্রধান মেজর সিদ্দিক সালিকও। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘোষণার খবরটি পাকিস্তান সরকার ও ইস্টার্ন জোনের সামরিক কর্মকর্তাদের অবহিত করেন।

ওয়্যারলেস বার্তাটি চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জহুর আহম্মেদ চৌধুরী পেয়ে রাতেই তা সাইক্লোস্টাইল করে বিলির ব্যবস্থা করেন।

পরদিন সেই  বার্তাটিই কালুরঘাট বেতার থেকে সর্বপ্রথম পাঠ করেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নান। তারপর বারবার ঘোষণাটি পড়ে শোনান অধ্যাপক আবুল কাশেম সন্দ্বীপ।

২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার এ ঘোষণাটি পাঠ করানোর জন্য মেজর জিয়াকে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে নিয়ে যান চট্টগ্রামের বেতার কর্মী বেলাল মোহাম্মদ, অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহম্মেদ ও অধ্যাপক আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন।

১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বাংলার মানুষের ভোটে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার আড়ালে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা।

নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহার কারণে বাংলার মুক্তকামী মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এমনই এক প্রেক্ষাপটে ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনী ঢাকাসহ সারাদেশে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ইতিহাসের বর্বরোচিত গণহত্যা শুরু করে।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, আজকের বাংলাদেশ পোস্ট

[email protected]