বজ্রপাত একটি আতঙ্কের নাম।তাই ঝড় উঠলে আমাদের বুক কাপে। এই বুঝি ঘাড়ের ওপর আঘাত হানলো বজ্রপাত।
শুধু বাংলাদেশ নয়- বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ বজ্রপাতে প্রাণ হারান। বিশেষ করে বষাকালে খেতে-খামারে কৃষি কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে প্রাণ হারান আমাদের অন্নদাতারা। শুধু কৃষক নয়- সাধারণ মানুষও প্রাণ হারান বজ্রপাতে।
কেননা বরষা-বাদলকালে ফাঁকা মাঠে তাঁদের কাজ করতে হয়। ধারে-কাছে কোন বাড়ি-ঘরও থাকে না যে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটে যাবেন।তাই এ সময়টায় হর-হামেশাই বজ্রপাতে তাঁদের প্রাণ হারাতে হয়।দেখা গিয়েছে- মার্চ-জুন মাসে মেঘ গজনের সঙ্গে বজ্রপাতটি বেশি ঘটে। এছাড়াও জুন ও জুলাই মাস পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের সাথে বজ্রপাত আঘাত হানে।এতে খালি মাঠে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে দুই শতাধিক অন্নদাতার মৃত্যু ঘটে।
কৃষকদের এমন নিদারুণ করুণ পরিনতি দেখে ও তাই তাঁদের বজ্রপাত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে ব্যতিক্রমী এক উদ্যোগ নিয়েছেন দেশের উত্তর জনপদ জেলা গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা কৃষি বিভাগ। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৈয়দ রেজা-ই মাহমুদ এর উদ্যোগে দুর্গম ও জনবসতি বিহীন এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে ‘কৃষকের ছাউনি’ নামে একটি আশ্রয়স্থল।
এতে ঝড়-বৃষ্টির সময় কৃষকেরা সহজে নিরাপদ আশ্রয় নিতে পারবেন। আর এ উদ্যোগটি ইতিমধ্যে সাড়া ফেলেছে সর্বত্র। প্রাথমিক অবস্থায় তিনটি কৃষকের ছাউনি নির্মাণ করে সুফল পেয়েছে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অফিস।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘শেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডর স্টম অ্যাওয়ারন্সে ফোরামে’র তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত বজ্রপাতে ৭৯ জন মারা গেছেন। এদের মধ্যে ১১ জন নারী এবং ৬৮ জনই পুরুষ। নারী ও পুরুষের মধ্যে ৩টি শিশু এবং ৯ জন কিশোর মারা গিয়েছে।
চলতি বছরে বজ্রাঘাতে জখম হয়েছেন ২১ জন। এ ছাড়াও গত বছর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ৩০০ জন মানুষ বজ্রাঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন।
গত এক বছরে সারাদেশে বজ্রপাতে প্রায় ২৩০ জন কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। আর চলতি বছরের জানুয়ারি-মে পর্যন্ত বজ্রপাতে মারা গেছে আরো অর্ধশত কৃষক। আর এসব মৃত্যুর কারণ হিসেবে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৈয়দ রেজা-ই মাহমুদ দুর্গম জায়গায় কাজ করা কৃষকদের তাৎক্ষণিক আশ্রয় না পাওয়াকে চিহ্নিত করেন।
এরপর ঝড়-বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে কৃষককে রক্ষার উপায় খুঁজতে থাকেন তিনি। বাস ও ট্রেন যাত্রীদের বসার জন্য যাত্রী ছাউনি দেখে চিন্তা করেন কৃষকের জন্য এমন একটি নিরাপদ ছাউনি নির্মাণের। তার ভাবনা বাস্তবায়ন করতে স্থানীয় সাংসদ ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের পরামরশ চান তিনি।
পরে আর্থিক সহায়তায় এগিয়ে আসেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। তার ব্যক্তিগত অর্থায়নে চলতি বছরের মার্চ মাসে বজ্রপাত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ রক্ষায় প্রাথমিক তিনটি ‘কৃষকের ছাউনি’ নির্মাণ করা হয়। এতে ধানের খর ও বাঁশ দিয়ে গোলাকৃতির একটি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে।
বজ্রপাত রুখতে একটি আর্থিং (লোহার দণ্ড) বসানো হয়েছে। প্রচণ্ড গরমে কৃষকের তৃষ্ণা মেটাতে নিরাপদ সুপেয় পানির ব্যবস্থাও করা হয়েছে সেখানে। এতে তিনটি কৃষকের ছাউনি নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৮৫ হাজার টাকা। টেকসই ও মানসম্মত এ ঘরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সহজে রক্ষা পাচ্ছেন কৃষক। ঝড়-বৃষ্টি ছাড়াও প্রচণ্ড গরমে একটু ছায়ায় গা জিরিয়ে নিচ্ছেন।
প্রাথমিক অবস্থায় এ ছাউনি কৃষকের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। পর্যায়ক্রমে উপজেলার সর্বত্র এমন কৃষকের ছাউনি নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল।এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৈয়দ রেজা-ই মাহমুদ বলেন, গত বছর বজ্রপাতে ২৩৩ জন কৃষকের মৃত্যু দেখে কৃষকদের হঠাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে কৃষকের ছাউনি নির্মাণের চিন্তা করি।
আশা করছি এই আইডিয়া প্রতিটি উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হলে বজ্রপাতে কৃষকের মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব।গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, কৃষি কর্মকর্তার ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগটি অসাধারণ।
দেশের সব উপজেলায় কৃষকের ছাউনি বাস্তবায়ন করলে বজ্রপাতে কৃষকের মৃত্যু হ্রাস করা যাবে। আগামী অর্থ বছরে এ উপজেলার সর্বত্র কৃষকের ছাউনি নির্মাণে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এস এস