ন্যাভিগেশন মেনু

মাজেদকেও পুরষ্কৃত করেছিল জিয়া, খুনিদের বিচারে বাঁধাও সৃষ্টি করে


জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর সব থেকে বেশি বেনিফিসিয়ারি হয়েছিল জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পৃষ্ঠপোষকতা শুধু নয় - তাদের পুরষ্কৃত করেছিল সেনাশাসক জিয়াউর রহমান। অবশ্য  তাকেও অপঘাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে।

অথচ বঙ্গবন্ধুর বদৌলতে একদা মেজর থেকে সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান হিসেবে পদোন্নতি লাভ করে। জিয়ার নিহতের পর দলের কিছু চামচার বদলে একেবারে ঘরের গৃহবধূ থেকে বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতে চলে আসে।ওই সময়ে বাংলাদেশের অস্থির রাজনীতির সুযোগে প্রধানমন্ত্রীও বনে যান।

জিয়া বঙ্গবন্ধুর দানের কৃতজ্ঞতা স্বীকার তো দূরের কথা বরং উল্টোটা দেখিয়ে আজ ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।এখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য জিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করে বিচারের কাঠগড়ায় তোলার দাবি উঠেছে।

ইতিহাস বলে ‘পাপ করে রেহাই পাওয়া যায়না, তা আবার প্রমাণ মিলল জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে।

এই জিয়াই অন্যান্য খুনিদের মতো মাজেদকেও পুরষ্কৃত করেছিল। জিয়ার নিহতের পর পলাতক জীবন শুরু হয় মাজেদের।

একের পর এক নানা দেশে পালিয়ে  ২৩ বছর আগে কলকাতায়ে এসে ঘাঁটি গাড়ে মাজেদ। গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত এতোদিন সে কলকাতায় অবস্থান করছিল। মাজেদ গত ১৬ মার্চ ঢাকায় ফেরে।

কলকাতার অভিজাত পার্ক স্ট্রিটের বেডফোর্ড লেনের ভাড়া বাড়িতে স্ত্রী সন্তান নিয়ে আয়েশেই থাকতো বঙ্গবন্ধুর ঘাতক আবদুল মাজেদ। সেখানে সে মাস্টারমশাই হিসেবেই পরিচিত ছিল।

পৃথিবীর ইতিহাসের ঘৃণ্যতম এই হত্যাকারীকে মহল্লায় কখনও উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখেনি কেউ। বেডফোর্ড রোডে মাস্টার সেজে তার অর্ধেক বয়সী এক নারীকে বিয়ে করে সংসার পেতেছিল সত্তোর্ধ বঙ্গবন্ধুর এই খুনি।

গত ৭ এপ্রিল বাংলাদেশের মিরপুরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি আব্দুল মাজেদ গ্রেপ্তারের পর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি দেখে রীতিমতো অবাক পার্ক স্ট্রিটের বেডফোর্ড লেনের বাসিন্দারা। তারা ভয়ে শিউরে উঠছেন খুনি কিভাবে রঙ পাল্টে দীর্ঘ সময় নিজেকে আড়াল করে রেখেছিল মাস্টার সেজে।

পার্ক স্ট্রিটে আবদুল মাজেদ পরিচিত ছিল আলি আহমেদ ওরফে ইংরেজির মাস্টার হিসেবে। এলাকার লোকে জানতো, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পাশ করেছে আলি আহমেদ (আবদুল মাজেদ)। টিউশন পড়িয়ে সংসার চালাতো সে। প্রথমে তালতলার ভাড়া বাড়িতে একাই থাকতো মাজেদ। পরে পার্ক স্ট্রিটে চলে যায়।

২০১১ সালে তার থেকে ৩২ বছরের ছোট উলুবেড়িয়ার সেলিনা বেগমকে বিয়ে করে মাজেদ। তাদের ছ’বছরের এক মেয়ে রয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরেই বছর বাহাত্তরের মাজেদের শরীর খারাপ যাচ্ছিলো। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে কলকাতার পিজি হাসপাতালে পরীক্ষা নিরীক্ষা করায় সে।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি পিজি হাসপাতাল থেকে সেই রিপোর্ট আনতে বাড়ি থেকে বের হয় খুনি মাজেদ। আর বাড়ি ফেরা হয়নি তার। তার উদ্বিগ্ন স্ত্রী সেলিনা ওইদিন রাতে পার্ক স্ট্রিট থানায় মিসিং ডায়েরি করে। তদন্ত শুরু করে পার্ক স্ট্রিট থানা।

এরপর পুলিশ মাজেদের ভাড়া বাড়ি থেকে একটি ব্যাগ পায়। সেই ব্যাগে তল্লাশি চালিয়ে সিম কার্ড, আধার কার্ড, ভোটার আইডি, ভারতীয় পাসপোর্ট এবং এক মহিলাসহ তিন শিশুর ছবি পাওয়া যায়।

স্ত্রী সেলিনা পুলিশকে জানায়, ব্যাগের মতো তার অন্যান্য ব্যক্তিগত জিনিসে কাউকে হাত দিতে দিতো না মাজেদ। মহল্লায় খুব একটা মেলামেশা করতো না সে। টিউশনির পাশাপাশি এলাকার এক চায়ের দোকান, রেশন দোকান এবং এক বিল্ডার্সের দোকানে আড্ডা দিতো মাজেদ।

ভাড়া বাড়ির সদর দরজায় সব সময় তালা লাগিয়ে রাখতো মাজেদ। বাইরের কোন লোকজনকে বাড়িতে ঢুকতে দিতো না। এক আধ বছর নয়, এভাবেই ১৮-১৯ বছর ডেরা বেঁধে কলকাতায় আত্মগোপন করেছিল বঙ্গবন্ধুর আত্নস্বীকৃত খুনি আবদুল মাজেদ।

সব জারিজুড়ি শেষ হয়ে যায় ৬ মার্চ রাত ৩টা ৪৫ মিনিটে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের সামনে দিয়ে সন্দেহজনকভাবে রিকশায় করে যাওয়ার সময় তাঁকে আটক করা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে মাজেদ স্বীকার করে, গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আত্মগোপন করেছিল।’রাষ্ট্রপক্ষ মাজেদকে জামিন না দিয়ে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করে।

রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন সরকারি কৌঁসুলি হেমায়েত উদ্দিন খান। আবদুল মাজেদ জানায়- বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আরও কয়েকজন খুনির সঙ্গে সে ব্যাংকক হয়ে লিবিয়া চলে যায়।

এরপর স্বঘোষিত সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান তাকে সেনেগালের দূতাবাসে বদলি করে।১৯৮০ সালে দেশে ফিরে আসার পর মাজেদকে বিআইডব্লিউটিসিতে চাকরি দেয় জিয়া।

সে সময় উপসচিব পদমর্যাদায় সে চাকরি করে। আর সেনাবাহিনী থেকে অবসরে চলে যায়। পরে সে সচিব পদেও পদোন্নতি পায়। পরে যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ে পরিচালক পদে যোগদান করে।

ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বাটামারা গ্রামের মরহুম আলী মিয়া চৌধুরীর ছেলে ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ। ১৯৭৫ সালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি অন্যান্য আসামিদের সঙ্গে সরাসরি অংশগ্রহণ করে। হত্যাকাণ্ড শেষে বঙ্গবন্ধু হত্যার অপর আসামি মেজর শাহরিয়ারসহ অন্যান্য সেনা সদস্যদের সঙ্গে রেডিও স্টেশনে দায়িত্ব পালন করে।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্য শুরু করলে আটক হওয়ার ভয়ে মাজেদ আত্মগোপন করে।

মাজেদ এসব তথ্য অকপটে স্বীকার করেছে  ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের সরকারি কৌঁসুলি হেমায়েত উদ্দিন খানের কাছে।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার শুরু করে। অবস্থা খারাপ বুঝে আত্মগোপনে চলে যায় মাজেদ। তার স্ত্রী ক্যান্টনমেন্ট আবাসিক এলাকায় বসবাস করছে। মাজেদের আগের পক্ষে চার কন্যা ও এক ছেলে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার নির্মমভাবে হত্যা করে কিছু বিপথগামী সেনা সদস্য। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর গোটাদেশের মানুষ এমন কাণ্ডে কিংকর্তৃব্য বিমূড় হয়ে পড়েন।

হিমালয় পর্বতসম এমন নেতার হত্যায় নেতাহীন দেশের মানুষ কোথায় যাবেন, কী করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না।কে দেবেন দিশাহীন পথ চলার নির্দেশ। 

জাতির জনককে হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য পদে পদে বাঁধা সৃষ্টি করে রাখে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বেশি সুবিধাভোগী ওই জিয়াউর রহমান।

জিয়া তার শাসনামলে দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেয়। কিন্তু প্রকৃতি কখনো অনিয়ম সহ্য করে না।তাকেও সেনাদের হাতেই প্রাণ দিতে হয়।

২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ জনগণের রায় নিয়ে শাসন ক্ষমতায় ফেরে।

১৯৯৬ সালে ১২ নভেম্বর আওয়ামী লীগ সরকার দায়মুক্তি আইন বাতিল করে। এবং ওই বছরের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন।

শুরু হয় এক ঐতিহাসিক বিচার পর্ব। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর  ঢাকার তৎকালীন দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় দেন।

বিজ্ঞ জজ কাজী গোলাম রসুল তাঁর রায়দানকালে এক পর্যায়ে বলেছিলেন খুনীদের শুধু ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা নয়, বরং তাদের গুলি করে দণ্ড কার্যকর করা উচিত ছিল।

ঢাকার নিম্ন আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে  আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করে। আসামিদের আপিল ও মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট দ্বিধাবিভক্ত রায় দেন।

২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেন। এরপর ১২ আসামির মধ্যে প্রথমে চারজন ও পরে এক আসামি আপিল করেন।

বিএনপির শাসনামলে ছয় বছর আপিল শুনানি না হওয়ায় আটকে যায় বিচার প্রক্রিয়া।দীর্ঘ ছয় বছর পর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে আপিল বিভাগে একজন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটি আবার গতি পায়।

২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির লিভ টু আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন।

ওই আপিলের অনুমতির প্রায় দুই বছর পর ২০০৯ সালের অক্টোবরে শুনানি শুরু হয়। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করেন।

ফলে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে হাইকোর্টের দেওয়া ১২ খুনির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে। এর মধ্য দিয়ে ১৩ বছর ধরে চলা এই মামলার বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হয়। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মুহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

ওই রায় কার্যকরের আগেই ২০০২ সালে পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা যান আসামি আজিজ পাশা।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, আজকের বাংলাদেশ পোস্ট

স এস