ন্যাভিগেশন মেনু

ইতিহাসবিদের চোখে ৭ই মার্চ ভাষণের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ


ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, বাঙালির স্বাধীনতার শপথের এক অবিস্মরণীয় দিন, ১৯৭১ সালের এই দিনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি,  বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখো জনতার সমাবেশে তার জাতির উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ রাখেন- ইতিহাসখ্যাত ৭ই মার্চের ভাষণ।মূলত বাঙালির আসন্ন সংগ্রামের রূপরেখা ও কৌশল তুলে ধরা হয়েছিল এই ভাষনে। সে দিন এই ভাষণ দেওয়া ছাড়া আর কেনো বিকল্প ছিলনা। কোন পরিস্থিতিতে তিনি এই ভাষণ দিয়েছিলেন তা না জানলে বর্তমান প্রজম্নের কাছে পাকিস্তান রাষ্ট্র, তার শাসক শ্রেণির চরিত্র এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিটি পরিষ্কার হবে না।

পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে  প্রতিষ্ঠার ২৩ বছরে কেনো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে। ৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয় লাভ করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদে (বর্তমানে বাংলাদেশ) ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টিতেই জয়ী হয় দলটি।বাংলার জনগনের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা জাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হবেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। বায়ান্ন থেকে সত্তর পর্যন্ত সমস্ত গণআন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির মনে যে স্বাধিকার চেতনার উন্মেষ ঘটে এ প্রত্যাশা তারই বহিঃপ্রকাশ।এই নির্বাচনের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ৩মার্চ ১৯৭১ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বসার ঘোষণা দেন। '১লা মার্চ হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সভা সকাল ১০ টা থেকে শুরু হয়।একই দিন পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন,যদি তারা পিপলস পার্টিকে বাদ দিয়ে ৩রা মার্চ  অধিবেশন বসে, তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত জীবনযাত্রা নিথর করে দেওয়া হবে।

১ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির এদিন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল। সমগ্র জাতি উৎসুক হয়ে চোখ-কান খোলা রেখেছিল টিভি ও রেডিওর দিকে। কিন্তু ইয়াহিয়া খানের বদলে আরেকজন মুখপাত্র ঘোষণা দিলেন: 'প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পরবর্তী ঘোষণার আগ পর্যন্ত জাতীয় অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, পাকিস্তান এখন গভীর রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। এই ঘোষণা বঙ্গবন্ধুকে ভীষণ ক্ষুব্ধ করে। সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, কোনো রাজনৈতিক সঙ্কট নয়, বরং পাকিস্তানি শাসকরা একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার ষড়যন্ত্র করছে। তিনি ২ ও ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেন। 

পরবর্তীকালে বাঙালিরা প্রথমবারের মতো স্বাধীনতার স্লোগান দিতে থাকে: 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো' প্রভৃতি। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।

 এই পরিস্থিতি বোঝাতে তোফায়েল আহমেদ লিখেছেন,হোটেল পূর্বাণীর চারদিক জনস্রোত।ঢাকা শহরে শ্লোগান আর শ্লোগান। জাগো জাগো বাঙালি জাগো',  'পদ্না-মেঘনা-যমুনা তোমার আমার ঠিকানা' বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো সোনার বাংলা মুক্ত কর', পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা',পাঞ্জাব না বাংলা,বাংলা - বাংলা',ভুট্টোর মুখে লাথি মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো'।হোটেল পূর্বাণীতে দেশ বিদেশের অগনিত সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর মুখেমুখি হওয়ার অপেক্ষায়। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু স্বভাবসুলভ দৃঢ়তা নিয়ে সাংবাদিকদের বললেন, 'বিনা চ্যালেঞ্জে আমি কোনো কিছুই ছাড়ব না।ছয় দফার প্রশ্নে আপোষ করব না'।দুই থেকে পাঁচ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিন বেলা ২ টা পর্যন্ত হরতাল চলবে।৭মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষনা করা হবে।ওইদিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলো ছাত্রলীগ আর ডাকসুর সমন্বয়ে। নেতৃত্বে ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ,আসম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন।

২ মার্চ ১৯৭১ এক দিকে হরতাল, মিছিল আর অন্যদিকে কারফিউ, সব মিলিয়ে ঢাকা শহর চরম উত্তপ্ত ছিল এ দিন। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, ড. মুনতাসীর মামুন লিখেছেন-  ১ থেকে ৭ ই মার্চ প্রতিদিন কিছু-না-কিছু ঘটতে থাকে ঢাকা শহরে, সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। ২ মার্চ,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-জনতার সামনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়।  রাস্তায় রাস্তায় মানুষ আর গগণবিদারী স্লোগান :' জয বাংলা', জ...য়...বা..ং...লা”।  সন্ধ্যায় জারি করা হয় কার্ফ্যু। মানুষ বলে 'জয় বাংলা' আর রাস্তায় নেমে; তোমার আমার টিকানা, 'পদ্না,  মেঘনা, যমুনা’ আর কার্ফ্যু ভাঙে: মানুষ বলে 'জয় বাংলা' আর গুলি খায়। আবারো বলে 'জয় বাংলা' আবার গুলি খায়। হাসপাতালে বুলেটবিদ্ধ মানুযের ভিড় বাড়তে থাকে আর গভীর রাতে শেখ মুজিব এক বিবৃতে বলেন,  "বাংলাদেশে আগুন জ্বলাবেন না। যদি জ্বালান ,  সে দাবান হতে আপনারাও রেহায় পাবেন না। .... সাবধান, শক্তি দিয়ে জনগণের মোকাবিলা করবেননা"।২রা মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলায় সর্বাতœক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন।পাকিস্তানি প্রশাসন সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. হারুন-অর রশিদ লিখেছেন- ২৫শে মার্চের বর্বর সামরিক হস্তক্ষেপ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই দেশ পরিচালিত হতে থাকে।তিনিই হয়ে উঠলেন ফব ভধপঃড় বা কার্যত সরকার প্রধান। তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটি পরিণত হলো ব্রিটেনের ১০ নম্বর ডাইনিং স্ট্রিটস্থ প্রধানমন্ত্রীর অফিস কাম- বাসভবন- এর অনুরূপ।

রেহমান সোবহান এ বিষয়ে মন্তব্য করে লিখেছেন 'আমার জানা মতে, সাম্প্রতিক ইতিহাসেও আন্দোলনকারী কোনো নেতা বঙ্গবন্ধুর মতো সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতা লাভের পূর্বেই দেশ ও জনগনের ওপর এমন পূর্ণ রাজনৈতিক কর্তৃত্ব আরোপ করতে সক্ষম হননি'।

একদিকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য ও অস্ত্রের সমাবেশ করতে ও মজুদ বাড়াতে থাকে, আপরদিকে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে জনতার সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।এ অবস্থায় রেডিকাল ছাত্র -যুবকদের পক্ষ থেকে স্বাধীনতা ঘোষনার জন্য বঙ্গবন্ধুর উপর চাপ আসতে থাকে।৭ মার্চ কর্মসূচি ঘোষিত হাওয়ার পর ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে,৩রা মার্চ স্বাধীনতার ইশতিহার পাঠ করে। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু কী বলবেন? দেশের ভেতরে এবং আন্ত জাতিক পর্যায়েও এ-প্রশ্ন উঠতে থাকে। 

তিনি কী এককভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন? তিনি কী শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে কোনো আপসরফার ইঙ্গিত দেবেন? ৭ই মার্চের জনসভা কী শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ থাকবে? উজ্জ্বীবিত জনতা কী ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করবে? আওয়ামী লীগের নেতারা ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু কী বলবেন তা নিয়ে আলোচনার জন্য বৈঠক করেন। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর উপরই ভাষণের বিষয় ঠিক করার দায়িত্ব অর্পিত হয়।

কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা ছিল বঙ্গবন্ধু কী বলবেন তা নিয়ে। যদি তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, সঙ্গে সঙ্গে হয়তো বিমান আক্রমণ শুরু হয়ে যাবে। সেনাবাহিনীও শুরু করবে নির্বিচার গণহত্যা। স্বাধীনতার জন্য যে প্রস্তুতি দরকার তা আমাদের আছে কিনা, আমরা ওই মুহূর্তের জন্য তৈরি কিনা তা নিয়ে দ্বিধা। দ্বিধা ছিল তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন কিনা তা নিয়েও। তিনি যদি স্বাধনিতা ঘোষণা না করেন তাহলে সেটা হবে আশাভঙ্গের সামিল। কারণ ছাত্ররা  আকাঙ্ক্ষাকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে, স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্পের জন্য তারা মানসিকভাবে প্রস্তুত নই। এই প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার ঘোষণা না এলে এই উন্মাতাল ছাত্র-শক্তি কোন অবস্থান নেবে তা নিয়েও ছিল শঙ্কা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার "কিছু স্মৃতি" তে লিখেছেন - " আমার মা আব্বাকে বললেন, সমগ্র  দেশের মানুষ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।  সবার ভাগ্য আজ তোমার উপর নির্ভর করছে। তুমি আজ একটা কথা মনে রাখবে, সামনে তোমার লাঠি, পেছনে বন্দুক। তোমার মনে যে কথা আছে তুমি তাই বলবে। অনেকে অনেক কথা বলতে বলেছে।  তোমার কথার ওপর সামনের অগণিত মানুষের ভগ্য জড়িত,  তাই তুমি নিজে যেভাবে বলতে চাও নিজের থেকে বলবে। তুমি যা বলবে সেটাই ঠিক হবে। দেশের মানুষ তোমাকে ভলোবাসে, ভরসা করে।ু

এ পরিস্থিতি বিশ্লষণে, ড. কামাল হোসেন লিখেছেন, ৭ মার্চ শেখ মুজিব কী বলবেন তা ঠিক করার জন্য ৬ মার্চ আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সভা। 'সারা দেশে প্রত্যাশা দেখা দিয়েছিল যে, ৭ মার্চ শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। বস্তুত, ছাত্র ও যুবসমাজ এ ধরনের ঘোষণার প্রবল পক্ষপাতী ছিল। ৭ মার্চ নাগাদ দলীয় সদস্যদের মধ্যে সামান্যই সন্দেহ ছিল যে, ছাত্রসমাজ, যুবসম্প্রদায় এবং রাজনীতি-সচেতন ব্যাপক জনগণের কাছে স্বাধীনতার চেয়ে কম কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য হবে না।

উৎকণ্ঠা অনেক কিছু নিয়েই ছিলো। অনেক প্রশ্ন ছিল সেদিন রেসকোর্সে সমবেত 'মানুষের মনে। বঙ্গবন্ধু আসতে পারবেন তো? বঙ্গবন্ধুর জীবন সংশয় হবে না তো? বঙ্গবন্ধু কী বলবেন? তিনি কী সরাসরি স্বাধীনতার ডাক দেবেন? এমনি অসংখ্য প্রশ্নে আন্দোলিত ছিল মানুষের মন। তবে এটা সবাই বুঝতে পেরেছিল যে, বাঙালি আর পেছনে ফিরে তাকাবে না, প্রস্তুত ছিল লড়াই করে সামনে এগিয়ে যাবার জন্যে, স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনার জন্যে। জনতার কাতার থেকেউঠে আসা জননায়ক বঙ্গবন্ধু জনতার এ মানসিকতা সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন; এবং তারই প্রতিফলন ছিল ৭ মার্চের ভাষণে।

বঙ্গবন্ধু এতটাই বিচক্ষণ ও দূরদর্শী ছিলেন যে ভাষনে তিনি একদিকে স্বাধীনতার ডাক দিলেন, অন্যদিকে শাসকের বিচ্ছন্নতাবাদী নেতা হিসাবে চিহ্নিত করার পাতানো ফাঁদেও পা দিলেন না।একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে দেশের অভ্যন্তরে কিংবা বহির্বিশ্বে যাতে চিহ্নিত না হন, এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু সদাসতর্ক ছিলেন। কথাজাদু দিয়ে তিনি নতুন মানচিত্রের ছবি এঁকেছেন, বাংলাদেশ নামক একটি নতুন রাষ্ট্রের রূপকল্প তুলে ধরেছেন।


মো:আরিফুল ইসলাম

প্রভাষক, ইতিহাস বিভাগ

হাবীবুল্লাহ্ বাহার কলেজ, ঢাকা