ন্যাভিগেশন মেনু

কায়সারের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল, সাক্ষী দিলেন এক বীরাঙ্গনার যুদ্ধশিশু


১৯৭১ সালে বাংলাদেশে রক্তক্ষয়ী নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ জেলায় নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণসহ যুদ্ধাপরাধের দায়ে সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মৃত্যুদণ্ডের যে রায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দিয়েছিল, দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়েও তা বহাল রয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মঙ্গলবারের এই সিদ্ধান্তের ফলে জাতীয় পার্টির সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে ফাঁসিকাষ্ঠেই যেতে হবে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার বিচারকের আপিল বেঞ্চ মঙ্গলবার মাত্র এক মিনিটে রায়ের সংক্ষিপ্তসার জানিয়ে দেয়।

কায়সারের আপিল আংশিক মঞ্জুর হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকে। এই বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি জিনাত আরা এবং বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান। একাত্তর সালে মুসলিম লিগ নেতা কায়সার ছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর একজন বিশ্বস্ত সহযোগী। ‘কায়সার বাহিন ‘  নামে দল গড়ে তিনি যেসব যুদ্ধাপরাধ ঘটিয়েছেন, সেজন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জের মানুষ তাকে একজন কুখ্যাত ব্যক্তি হিসাবেই চেনে।

সেই কায়সারই স্বাধীন বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানের আমলে হয়ে যান বিএনপির লোক, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময় জাতীয় পার্টির দল বদলের কৌশলে প্রতিমন্ত্রীও বনে যান। পাঁচ বছর আগে ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে বলেছিল, “কায়সার এতোটাই নগ্নভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষ নিয়েছিলেন যে নিজের গ্রামের নারীদের ভোগের জন্য পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিতেও কুণ্ঠিত হননি।

সেই রয়ে সাতটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কায়সারকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, যার মধ্যে দুই নারীকে ধর্ষণের ঘটনা রয়েছে। এই দুই বীরাঙ্গনার মধ্যে একজন এবং তার গর্ভে জন্ম নেওয়া এক যুদ্ধশিশু এ মামলায় সাক্ষ্যও দেন। আর একটি ঘটনায় ছিল নির্বিচারে হত্যার অভিযোগ।

এছাড়া অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যায় সংশ্লিষ্টতার চারটি অভিযোগে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং তিনটি অভিযোগে আরও ২২ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর আপিলে আসা এটি নবম মামলা, যার ওপর চূড়ান্ত রায় হলো। ২০১৩ সালের ১৫ মে ট্রাইব্যুনাল কায়সারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে সেই রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় মুসলিম লিগের এই সাবেক নেতাকে।

বয়স ও স্বাস্থ্যগত পরিস্থিতি বিবেচনায় ট্রাইব্যুনালে তাকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেয়। যুদ্ধাপরাধের ১৬টি ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে পরের বছর ২ ফেব্রুয়ারি সৈয়দ কায়সারের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। সেই বিচার শেষে ২০১৪ সলের ২৩ ডিসেম্বর তার মৃত্যুদণ্ডের রায় আসে।

মঙ্গলবার আপিল বিভাগের রায়ের সময় তিনি ছিলেন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারের কনডেম সেলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিকে ‘দমনের অস্ত্র হিসাবে’ ধর্ষণের ব্যবহার এবং সেই পাশবিকতার শিকার নারীদের দুর্দশার কথা বার বার উঠে আসে এই রায়ে।

একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে নির্যাতিত আড়াই লাখ বীরাঙ্গনা ও তাদের গর্ভে জন্ম নেওয়া যুদ্ধশিশুদের ট্রাইব্যুনাল উল্লেখ করে ‘জাতীয় বীর’ হিসাবে।রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন- তারা আমাদেরই মা, আমাদেরই বোন।

আমরা আর চোখ বন্ধ করে রাখতে পারি না। বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের প্রাপ্য সম্মান দেখাতে তাদের দুর্দশা কমানোর জন্য সরকার দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলেও রায়ে আশা প্রকাশ করা হয়। সৈয়দ কায়সারের জন্ম ১৯৪০ সালের ১৯ জুন।

তার বাবা সৈয়দ সঈদউদ্দিন ১৯৬২ সালে সিলেট-৭ আসন থেকে কনভেনশন মুসলিম লিগের এমএলএ নির্বাচিত হন। ওই বছরই মুসলিম লিগের রাজনীতিতে যুক্ত হন তার ছেলে কায়সার।১৯৭১ সালে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ৭০০ ‘স্বাধীনতাবিরোধীকে’ নিয়ে ‘কায়সার বাহিনী’ গঠন করেন।

তিনি নিজে ছিলেন ওই বাহিনীর প্রধান। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করার ঠিক আগে কায়সার পালিয়ে লন্ডনে চলে যান। দেশে ফেরেন ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর।

জিয়াউর রহমানের সময় ১৯৭৮ সালে আবারো রাজনীতিতে সক্রিয় হন কায়সার। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১৭ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন। পরে তিনি জিয়ার  বিএনপিতে যোগ দেন এবং হবিগঞ্জ বিএনপির সভাপতি হন।

সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়ে কায়সার জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং হবিগঞ্জ শাখার সভাপতির দায়িত্ব পান। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে হবিগঞ্জ-৪ আসন থেকে লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করে আবারও দুই দফা তিনি সংসদ সদস্য হন।

ওই সময় তাকে কৃষি প্রতিমন্ত্রীরও দায়িত্ব দেন এরশাদ। কায়সারের ফাঁসির রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা।জেলায় বিভিন্ন সংগঠন আনন্দ মিছিল করেছে।

এস এস