ন্যাভিগেশন মেনু

করোনায় যুক্তরাষ্ট্রে গ্রোসারিতে রমরমা থাকলেও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত


করোনার মধ্যে গ্রোসারিগুলো চুটিয়ে ব্যবসা করলেও টিকতে পারছে না কমিউনিটিভিত্তিক রেস্টুরেন্টগুলো। বিশেষ করে রমজানে প্রতিবছর রেস্টুরেন্টগুলো যে ব্যবসা করে তা বছরের অন্য ১১ মাসের চেয়েও বেশী বলে মালিকেরা জানান। 

কিন্তু এবার ভিন্ন পরিস্থিতিতে রেস্টুরেন্ট খোলা রাখলে কর্মচারির বেতন দূরের কথা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি বিলের সমপরিমাণও বিক্রি হচ্ছে না। এর ফলে করোনার কারণে নিউইয়র্কসহ সমগ্র আমেরিকায় সবচেয়ে বেশী ক্ষতির শিকার হচ্ছে রেস্টুরেন্টগুলো।

গত বছর শুধুমাত্র নিউইয়র্ক সিটিতে ৩ শতাধিক সংগঠনের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া কমপক্ষে ৪০টি মসজিদে প্রতিদিনই ইফতার বিতরণ করা হয়েছে মুসল্লীদের মধ্যে। পারিবারিক আমেজেও ছোট ছোট ইফতার পার্টি হয়েছে। এসব পার্টিতে ইফতারি বক্স সরবরাহ করেছে রেস্টুরেন্টগুলো। অর্থাৎ মিলিয়ন ডলারের অধিক ব্যবসা হয়েছে রমজানে শুধু ক্যাটারিংয়ে। 

এর বাইরে রয়েছে রেস্টুরেন্টে ইফতার গ্রহণকারী এবং চলতি পথে ইফতারি বক্স ক্রেতারা। সবকিছু মিলিয়ে দুই মিলিয়ন ডলারের নিশ্চিত ব্যবসা থেকে চরমভাবে বঞ্চিত হলো রেস্টুরেন্টগুলো। এই ঘাটতি পূরণ করা একেবারেই সম্ভব নয় বলে ১৮ মে সোমবার ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। 

নিউইয়র্ক সিটির ব্রুকলিনের চার্চ-ম্যাকডোনাল্ডে বাংলানগর সুপারমার্কেট এবং বনফুল রেস্টুরেন্টের মালিক মো. আনোয়ার হোসেন জানান, করোনাভাইরাসের কারণে এই সিটিতে লকডাউনের ঘোষণা আসার প্রাক্কালে কয়েকদিন ধরেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন কাস্টমাররা। ঈদ উপলক্ষে কেনাকাটার চেয়ে মাত্রা ছিল বেশি। সকলেই অতিরিক্ত খাদ্য-সামগ্রি ক্রয় করেছেন। এরপর ২০ মার্চ লকডাউন শুরুর প্রথম সপ্তাহে তেমন ক্রেতা দেখিনি। কিন্তু এখন আবার বেড়েছে।

কারণ, আগের কেনা খাদ্য-সামগ্রি ফুরিয়ে গেছে। ঘরের বাইরে বের হবার অনুমতি না থাকলেও খাদ্যসামগ্রী কেনার জন্যে সকলেই আসছেন। ফলে গ্রোসারি ব্যবসায় তেমন একটা মন্দাভাব আমি দেখছি না। তবে রেস্টরেন্ট ব্যবসায় ধস নেমেছে। 

চার্চ-ম্যাকডোনাল্ড বাংলাদেশি বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের (সিএমএমবিবিএ)’র নেতা আনোয়ার হোসেন আরও বলেন, রমজান উপলক্ষে কমিউনিটির সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পেশাজীবী-আঞ্চলিক সংগঠন ছাড়াও রাজনৈতিক সংগঠনের উদ্যোগে ইফতার পার্টি হতো। মসজিদে প্রতিদিনই ইফতার বিতরণ করার জন্যে রেস্টুরেন্ট থেকে তা কেনা হতো। রেস্টুরেন্টে দলবেধে বসেও অনেকে ইফতার করতেন। এবার কিছুই নেই। 

আনোয়ার হোসেন বললেন, প্রতিদিনই বিভিন্ন আইটেমের পণ্য তৈরী করছি ইফতারের জন্যে। মূল্যও তুলনামূলকভাবে কম ধার্য করেছি। কিন্তু কাস্টমার নেই। 

উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশী তথা দক্ষিণ এশিয়ানদের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে সবচেয়ে বড় ‘খাবার বাড়ি’ রেস্টুরেন্ট এবং জ্যামাইকায় খামার বাড়ি সুপার মার্কেটের মালিক  মো. কামরুজ্জামান কামরু বলেন, গ্রোসারি ব্যবসা ভালোভাবেই চলছে। তবে বিপদে রয়েছি রেস্টুরেন্ট নিয়ে। প্রতিদিনই বিপুল অর্থ লোকসান দিতে হচ্ছে। কারণ, ইফতার পার্টি নেই, ক্যাটারিং নেই, ফ্লোটিং কাস্টমারও আসছেন না। সকলেই গৃহবন্দি বিধায় কাচামাল গ্রোসারি থেকে ক্রয় করে ঘরেই তৈরী করছেন সবকিছু। 

জ্যাকসন হাইটস বাংলাদেশি বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন (জেবিবিএ)’র সেক্রেটারি কামরুজ্জামান কামরু আরও বলেন, অথচ প্রতি রমজানের ৩০ দিন যে ব্যবসা হতো তা বছরের অন্য ১১ মাসের চেয়েও বেশী ছিল। এরফলে যারা শুধুমাত্র রেস্টুরেন্ট ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল তাদের পক্ষে টিকে থাকা সত্বি কষ্টকর হয়েছে। 

তিনি উল্লেখ করেন, লকডাউন উঠিয়ে নেয়ার পরও রেস্টুরেন্টের ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক জায়গায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আসন সাজাতে হবে। অর্থাৎ তারপরও ব্যবসায়িক সংকট কাটবে বলে মনে হচ্ছে না। 

নিউইয়র্কে রসগোল্লার জন্যে জনপ্রিয় ‘আব্দুল্লাহ সুইটস’র মালিক সুলতান আহমেদ বলেন, লোকসানের কারণে জ্যাকসন হাইটসের রেস্টুরেন্ট বন্ধ রেখেছি। খোলা রয়েছে ব্রুকলিনে চার্চ-ম্যাকডোনাল্ডস্থ রেস্টুরেন্ট। কিন্তু বিক্রি নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় কর্মচারি বেতন এবং রেস্টুরেন্টের বাড়ি ভাড়া কোত্থেকে আসবে সেটিই ভাবনার বিষয়। করোনায় স্বাস্থ্যনীতি মেনে চলায় এখন পর্যন্ত সুস্থ থাকলেও রেস্টুরেন্ট দুটির মাসিক ভাড়া নিয়ে মহাদুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছি।  

উল্লেখ্য, নিউইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটস, এস্টোরিয়া, জ্যামাইকা, ওজনপার্ক, নিউকার্ক, চার্চ-ম্যাকডোনাল্ড, পার্কচেস্টার, ম্যানহাটানের সিক্সথ স্ট্রিট, লেক্সিংটন এভিনিউ, মিডটাউন ম্যানহাটান প্রভৃতি এলাকায় বাংলাদেশি মালিকানাধীন শতাধিক রেস্টুরেন্টের প্রতিটি বিরাট লোকসানের মুখে। অনেকেই ব্যাংক্রাপসি ঘোষণার কথা ভাবছেন বলে জানা গেছে। 

কারণ, করোনা স্টিমুলাম অনুযায়ী ক্ষুদ্র ব্যবসার ঋণ পেতে যেসব ক্রাইটেরিয়া থাকা দরকার, তার অধিকাংশই নেই এসব রেস্টুরেন্টের। প্রায় প্রতিটি রেস্টুরেন্টের কর্মচারিই নগদে সাপ্তাহিক বেতন নিয়েছেন। 

এদিকে, পোয়াবারো হয়েছে গ্রোসারি ও সুপারমার্কেটগুলোর। তারা করোনার আভাস পাবার পরই ক্রেতা বেড়ে যাওয়ায় সবপণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বর্ধিত মূল্য এখনও অব্যাহত থাকায় ক্রেতা সাধারণেরও গা সওয়া হয়ে গেছে। 

সরকারী শ্রম দফতরের সরেজমিন অনুসন্ধানভিত্তিক এক জরিপে মঙ্গলবার উল্লেখ করা হয়েছে, মাংস, দুধ, ডিম, চাল, ডাল, মাছ, বেকারি পণ্য, ফল-মূল, শাক-সব্জি, সিরিয়াল, চিনি, মধুসহ সবকিছুতেই ৩ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ানো হয়েছে। ডিমের দাম ১৬ শতাংশ বৃদ্ধিকে শত বছরের ইতিহাসে সর্বপ্রথম এমন ঘটনা বলে অভিহিত করা হয়েছে। অথচ সবকিছুরই সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে। 

উল্লেখ্য যে, মূল্যবৃদ্ধির এই প্রবণতা সবদেশী সুপারমার্কেটেই ঘটেছে। ফুড ইন্ডাস্ট্রি অ্যানালিস্ট এবং সুপারমার্কেট গুরুর সম্পাদক ফিল লেমপার্ট এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, লকডাউন পুরোপুরিভাবে উঠিয়ে নেওয়ার পর দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক হবে বলে কেউই মনে করছেন না। কারণ, কৃষক থেকে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকারি এবং প্রক্রিয়াজাতকরণকারি থেকে গ্রোসারি স্টোর পর্যন্ত সকলেই বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছেন সামনের দিনের চাহিদা পূরণের মাধ্যমে নিজ নিজ ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে। 

আরেকটি বিষয়ে সকলের মনোযোগ রয়েছে যে, লকডাউন উঠিয়ে নেওয়ার পরও প্রতিটি কর্মচারিকে ৬ ফুট অন্তর অবস্থান করে কাজ করতে হবে। মাস্ক ব্যবহারের নির্দেশও বহাল থাকবে বহুদিন ধরে। ফার্মে ঢুকতেই সেনিটাইজার ব্যবহার করতে হবে। দোকানে ক্রেতা ঢুকানোর জন্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সিকিউরিটি গার্ড লাগবে। ক্যাশিয়ারের সামনে প্লেক্সিগ্লাস ব্যারিয়ার লাগাতে হয়েছে ক্রেতার সাথে ক্যাশিয়ারের দূরত্ব নিশ্চিতের জন্যে। এসব বাড়তি খরচ পুষিয়ে নিতে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির বিকল্প থাকবে না।  

লেমপার্ট উল্লেখ করেছেন যে, এধরনের পরিস্থিতি সামলে উঠতে দুই/তিন বছর সময় লাগবে সর্বস্তরে। এরপরই হয়তো মনে হতে পারে যে সবকিছু স্বাভাবিক হচ্ছে।

এডিবি/