ন্যাভিগেশন মেনু

ঘরে বসে কফি আড্ডায় নিউইয়র্কের বাংলাদেশিরা


বৈশ্বিক করোনাভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রায় সব দেশেই চলছে লকডাউন।বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এ অবস্থায় বলেছেন ঘরবন্দি মানুষের কষ্ট হচ্ছে বেজায়, কিন্তু বাঁচার জন্য এর কোন বিকল্প নেই। 

লকডাউনের জেরে প্রায় ছয় সপ্তাহ ধরে গৃহবন্দি থেকে হাঁপিয়ে উঠেছেন, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান (১৯৭২-৭৫) অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। বয়স একানব্বই বছর।

চোখে কম দেখলেও পত্র-পত্রিকা নিয়মিত পড়েন।বহু বছরের পুরনো ব্রেইন টিউমার, ভাঙা পা, নড়বড়ে কোমর, দুই চোখের ম্যাকুলার ডিজেনারেশন, সিওপিডি’র শ্বাসকষ্ট, এবং সারা শরীরে অসম্ভব ব্যথা নিয়ে থাকলেও তার সাথে কথা বললে এসবের কিছুই বোঝার উপায় থাকে না।  

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধকল্পে সকলেই গৃহবন্দি ২১ মার্চ থেকে। এর আগে নূরুল ইসলামসহ সমবয়েসী অথবা কাছাকাছি বয়েসীদের মধ্যে সমমনাদের সাথে প্রায় প্রত্যেক শনিবারেই কফির আড্ডায় বসতেন ম্যারিল্যান্ড অঙ্গরাজের মন্টগোমারির একটি মলে।

সেই আড্ডায় পরস্পরের কুশলাদি ছাড়াও পড়ন্ত বয়সে কার কীভাবে দিন কাটছে এবং প্রিয় মাতৃভূমির সামগ্রিক কল্যাণে কে কী করছেন তাও আলোচিত হতো। 

মতবিনিময় করার জন্য শনিবারের এই কফির আড্ডাতে যেতে পারলে সব কষ্ট তারা ভুলে যেতেন। করোনার উপদ্রবে তা বন্ধ হয়ে গেলে নূরুল ইসলামের উৎসাহ এবং প্রস্তাবে প্রথমবারের মত গত ১১ এপ্রিল শনিবার আয়োজন করা হয়েছিল ‘ভার্চুয়াল আড্ডার’। 

প্রধান দুই আয়োজক ছিলেন ড. মহসিন সিদ্দীক (৭৬) এবং ওয়াহেদ হোসেইনী (৮৩)। ‘যুম’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অনলাইনে ভিডিও আড্ডায় আরো আরো অংশ নেন খ্যাতনামা সংবাদ-ভাষ্যকার ইকবাল বাহার চৌধুরি (৮০) এবং জিয়াউদ্দিন চৌধুরী (৮১)। 

আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল সেদিন কয়েকঘন্টা আগে করোনাক্রমণে নতি শিকার করা ডাক্তার আবদুল মান্নানের মৃত্যু। অধ্যাপক নুরুল ইসলামের অতি নিকটজন ছিলেন তিনি। প্রায়ই দেখা হতো, একসাথে খেতে এবং চা পান করতে যেতেন। 

রিহ্যাব সেন্টারে স্থানান্তরের পরও ফোনে কথা হয় কিছুদিন আগেও। শেষবার ফোনে না পাওয়ার কয়েকদিন পর মৃত্যুসংবাদ পেলেন। খুবই দুঃখ পেয়েছেন সকলে। কারণ তিনি ওয়াশিংটন মেট্র এলাকার প্রবাসীদের পাশে থাকতেন সবসময়। 

সাংবাদিক ইকবাল বাহার চৌধুরি মেরিল্যান্ডের রকভিল শহরে নিজের বাসায় বাস করেন। ছেলের বাসা কাছেই। ছেলে, বৌমা, এবং নাতিদের সাথে তার সময় কাটে। বাংলাদেশ থেকে মাত্র দু’সপ্তাহ আগে আমেরিকার বিশেষ ফ্লাইটে এসেছেন তিনি। 

বিশ্বব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত পদস্থ কর্মকর্তা আব্দুন নূর (৭৯) বাস করছেন ভার্জিনিয়ায়। লেখালেখী ছাড়াও বাংলাদেশের কল্যাণের কথা ভাবেন সব সময়। ম্যারিল্যান্ডের ব্যাথেসডায় বসবাসরত সমাজকর্মী ও ব্যবসায়ী আজমত আলী (৮২) ও করোনায় অবরুদ্ধ হয়ে নিজ বাসায় অবস্থান করলেও সমবয়েসী এবং সমমনাদের সাথে ফোনে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন।

ডঃ মহসিন সিদ্দীক (৭৫) ওয়াশিংটন ডিসি ওয়াটার এ্যান্ড সুয়ার অথরিটিতে খন্ডকালীন কর্মরত। এক্ষণে বাসা থেকেই কাজ করছেন। থাকেন স্ত্রীসহ মেরিল্যান্ডের বেথেসডায়।

সমাজকর্মী ওয়াহেদ হোসেইনী, থাকেন ভার্জিনিয়ার স্প্রিংফিল্ড শহরে। কানে কিছুটা কম শোনেন কিন্তু অন্য সবকিছুতে জ্ঞান তার টনটনে। বাংলাদেশ কমিউনিটির কারো মৃত্যু সংবাদ তার ইমেইলেই সবাই প্রথম জানতে পারেন। স্ত্রীসহ গৃহবন্দি। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে নাতনীসহ কন্যা গাড়িতে বসে দেখে যায়। 

ড. সুলতান আহমদ (৮৩), বিশ্বব্যাংকের প্রাক্তন কর্মকর্তা। স্ত্রীসহ থাকেন ভার্জিনিয়ার ভিয়েনায়। বড়মেয়ে থাকেন কাছেই। ছেলেমেয়ে সবাই প্রতিনিয়ত খোঁজ নিয়ে যায়। সপ্তাহে তিনবার কিডনি ডায়ালাইসিস করতে হয়, সাথে যান প্রায় সমবয়সী স্ত্রী। করোনার দিনে স্ত্রী সংক্রমিত হতে পারেন এই দুশ্চিন্তায় দিন কাটে তার।

আবু সোলায়মান(৮৭),ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মী। থাকেন মেরিল্যান্ডের বেথেসডা শহরে স্ত্রী এবং একটি কাজের লোক নিয়ে। পাচ মিনিট দূরে থাকেন তার বড়ছেলে ড. মিলন। তিনিই মা-বাবার জন্য বাজার-সদাই করে দিয়ে যান। 

রোজবুশ প্রফেসর এমিরিটাস ড. জিল্লুর আর খান(৮৫) বাস করছেন স্ত্রীসহ ফ্লোরিডার ওরল্যান্ডোতে। হাঁটতে পারেন না। হুইল চেয়ার তার অবলম্বন। এমনি অবস্থায় এই পড়ন্ত বয়সেও প্রবাসীদের খোঁজ-খবর নেন। বাংলাদেশে প্রিয়জনদের সাথে ফোনে কথা বলার পাশাপাশি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ কতটা এগুচ্ছে-তা জানতে চান। 

বাংলাদেশের সর্বশেষ বহুল আলোচিত/সমালোচিত কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান ড. ফখরুদ্দিন আহমেদ (৭৯) স্ত্রীসহ বাস করছেন ম্যারিল্যান্ডের ব্যাথেসডায়। করোনায় অবরুদ্ধ জীবন শুরু থেকেই নিউইয়র্ক থেকে পুত্র এবং পুত্রবধূ ছুটে গেছেন তার কাছে। সমমনা এবং সমবয়েসীদের সাথে ফোনে কথা বলার পাশাপাশি স্বজনের সান্নিধ্যে থাকায় তার একাকীত্ব ঘুচেছে। তিনি বাংলাদেশের সকল মানুষের সুস্বাস্থ্য কামনা করেছেন।

একই কেয়ারটেকার সরকারের চালিকাশক্তি হিসেবে পরিচিত অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ (৬৭) স্ত্রী এবং পুত্রের সাথে ফ্লোরিডায় ওয়েস্ট পামবীচে বসবাস করছেন। অবরুদ্ধ জীবনে প্রিয়-পরিচিত এবং সমমনাদের সাথে ফোনে কথা বলার পাশাপাশি বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর গভীর পর্যবেক্ষণ রেখেছেন। 

সকলের সুস্বাস্থ্য কামনা করেছেন। জেনারেল মঈন বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন যে, করোনা পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকেও আর্থিকভাবে বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে হবে। সেটি মোকাবেলায় এখন থেকেই সার্বিক প্রস্তুতি দরকার। বিশেষ করে চিনের গার্মেন্ট রপ্তানীতে যে ভাটা পড়েছে সেই স্থান দখলের চেষ্টা করতে হবে। 

মাস্ক, পিপিই উৎপাদন বহুগুণ বাড়িয়ে তা এই সংকটে বাংলাদেশের চাহিদা পূরণের পর বিদেশে রফতানীর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী। স্বল্প সময়ে যেসব খাদ্য-সামগ্রি উৎপন্ন করা সম্ভব, সেদিকে নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে শুধু এককভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কথা বললে হবে না। মন্ত্রী, এমপি, উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ সকল রাজনীতিককে সরব হতে হবে। 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৪ নম্বর সেক্টর কমান্ডারস জেনারেল সি আর দত্ত বীরউত্তম বাস করছেন ফ্লোরিডায় বয়েন্টনবীচে কন্যার সাথে। ৯৩ বছর বয়েসী এই জেনারেলের সময় কাটে বাংলা ভাষার পত্রিকা পাঠ এবং বাংলাদেশি টিভির অনুষ্ঠান দেখে। তিনি করোনায় যারা প্রাণ হারিয়েছে তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা এবং বিশ্ব মানবতাকে এহেন কঠিন একটি যন্ত্রনা থেকে অব্যাহতি প্রদানের জন্যে পরম করুণাময়ের দয়া চান। 

৯৩ বছর বয়েসী সংবাদ-ভাষ্যকার কাফি খান বাস করছেন ভার্জিনিয়ায়। কফির আড্ডায় তিনিও ছিলেন সরব। বয়সের ভারে যতটা ন্যুব্জ হবার কথা, তার কিয়দংশ প্রকাশিত হয় না আলাপ-চারিতায়।

এস এস