ন্যাভিগেশন মেনু

জালিয়াতির মাধ্যমে কলেজ শিক্ষকের পদোন্নতি!


সরকারি কলেজের শিক্ষককে নিয়ম না মেনে পদোন্নতি দেওয়ার ঘটনাকে ঘিরে ক্ষোভ ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। ওই শিক্ষকের বার্ষিক-গোপনীয়-অনুবেদন (এসিআর) পরীক্ষা না করেই পদোন্নতি দেয়া হয়েছে বলে গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত এই কর্মকর্তার নাম মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির।  যিনি ২৪তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারী চাকুরীতে যোগদান করেন। এর আগে তিনি নোয়াখালী সরকারী মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেছেন।

গত ২৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে হুমায়ুন কবিরকে সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। সহযোগী অধ্যাপক পদ শিক্ষা ক্যাডার সার্ভিসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ। তিনি এখন নোয়াখালী সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।

গত শনিবার বাংলাদেশ পোস্ট-এর সাথে কথা বলার সময় নোয়াখালী সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর আকতারী বেগম অভিযোগ করেছেন যে, তাঁর সাবেক সহকর্মী তাঁর কাছ থেকে  ২০১৮ এবং ২০১৯ সালের এসিআর নেননি। কিন্তু তাঁর পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

সব অভিযোগ অস্বীকার করে হুমায়ুন কবির বলেন, ‌‌''এসব আমার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র। এসিআর জমা দেওয়া আমার দায়িত্ব নয়, এটা উপাধ্যক্ষ ও প্রিন্সিপালের দায়িত্ব। আমি আমার এসিআর ফর্ম তৎকালীন উপাধ্যক্ষের কাছে জমা দিয়েছিলাম। পরবর্তীতে তিনি এসিআর অধ্যক্ষের কাছে পাঠিয়েছেন কিনা আমি জানি না।''

সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, যে কোনো কর্মচারী ও কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য তার এসিআর  চেক করা আবশ্যক।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রফেসর আকতারী বেগম ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর নোয়াখালী সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ২০২১ সালের ৬ জুলাই পর্যন্ত ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। হুমায়ুন কবিরও ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর একই কলেজের ইংরেজি বিভাগে সহকারী প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ২০২০ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত কলেজে কর্মরত ছিলেন। এসময় তিনি অধ্যাপক আকতারী বেগমের অধীনে প্রায় পাঁচ বছর কর্মরত ছিলেন।

কিন্তু তিনি  ২০১৮ এবং ২০১৯ সালের এসিআরের অধ্যাপক আকতারী বেগমের প্রতিস্বাক্ষর নেননি বলে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। অভিযোগের একটি কপি বাংলাদেশ পোস্টের এই প্রতিবেদকের কাছেও এসেছে।

নিয়ম অনুযায়ী হুয়ায়ুন কবির উপাধ্যক্ষের কাছে এসিআরফর্ম জমা দিবেন। এরপর উপাধ্যক্ষ হুয়ায়ুন কবিরের এসিআর লিখবেন এবং অধ্যক্ষের কাছে পাঠাবেন। অধ্যক্ষ এসিআরে নম্বর দিয়ে এবং সেটি সিলগালা করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠাবেন। কোন অবস্থাতেই কাউকে হাতে হাতে এসিআর দেয়ার বিধান নেই।

বাংলাদেশ পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে অধ্যাপক আকতারী বেগমও বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, “আমি কয়েকবার লক্ষ্য করেছি হুমায়ুন কবিরের এসিআর প্রতিস্বাক্ষরের জন্য আমার কাছে আসছে। পরে আমি তাকে তাগাদাও দিয়েছি।''

অপর এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আকতারী বলেন, ''পরে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) -এর নজরে আনি বিষয়টি। কিন্তু তিনিও এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেননি।'' তিনি অভিযোগ করেন, হুমায়ুন কবিরের নাম  দেখে  মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) অজ্ঞাত কারণে নীরব ছিলেন।

অধ্যাপক আকতারী বেগম আরও দাবি করেন, তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এসিআর বিভাগের কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিউল্লাহকেও মৌখিকভাবে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। তবে পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কিনা জানি না, তিনি আরো যোগ করেন।

২০১৫ সালে নোয়াখালী সরকারি মহিলা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর ইকরামুল হকের স্বাক্ষর জাল করে মাউশিতে জমা দেন বলেও হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।

অধ্যাপক আকতারী বেগম বলেন, তিন বছরের এসিআর পরীক্ষা না করে বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হলে তা প্রশাসনের জন্য সম্পূর্ণ আপত্তিকর ও বিব্রতকর।

সহযোগী অধ্যাপক হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এসিআর শাখায় কর্মরত শিক্ষা কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, এসিআর ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার নিয়ম নেই। তিনি অবশ্য বলেন, কিছু ক্ষেত্রে যেমন কোন অফিসার যদি মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থাকেন, অধ্যয়ন ছুটিতে থাকেন, লিয়েনে থাকেন বা কোনো মামলার সম্মুখীন হন, তাহলে তাঁর এসিআর জমা দেয়ার প্রয়োজন হয় না। কেউ এসিআর জমা না দিলে,কিংবা তাঁর এসিআর লুকিয়ে রাখলে তাঁর পদোন্নতি বৈধ নয় বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে শরিফুল বলেন, একজন কর্মকর্তাকে তাঁর তত্ত্বাবধায়ক কর্মকর্তার কাছ থেকেই এসিআর নিতে হবে। এই নিয়মের অন্য কোনো বিকল্প নেই।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্ম-সচিব (শৃঙ্খলা) মুকেশ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, তিনি পদোন্নতির প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। এ ধরনের কোনো অভিযোগ তাঁর কাছে এলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) শাহেদুল খবীর চৌধুরী বলেন, এসিআর ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার কোনো কারণ নেই। এসিআর যাচাইয়ের জন্য মন্ত্রণালয়ে একটি কমিটি রয়েছে। যাচাই-বাছাইয়ের ভিত্তিতে পদোন্নতির একটি তালিকা তৈরি করা হয়। পরে কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়।

হুমায়ুন কবির এসিআর জমা দেন নাই বলে তাঁকে জানানোর পরও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার দিক থেকে এটা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন যে মাউশি এসিআরের বিষয়টি দেখাশোনা করেন।

বাংলাদেশ পোস্ট-এর প্রতিবেদক একাধিকবার শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সুলেমান খান এবং মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদের কাছে এসিআর ছাড়াই হুমায়ূন কবীরের পদোন্নতির বিষয়ে তাদের মন্তব্যের জন্য একাধিকবার ফোন করেছিল।

এই প্রতিবেদক তাদের ব্যবহৃত হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এসএমএসও পাঠিয়েছিল। কিন্তু ১০ মার্চ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তারা কোনো সাড়া দেননি।