ন্যাভিগেশন মেনু

দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে গড় আয়ু এখন সবচেয়ে বেশি

৩০ বছরে দেশে মৃত্যুর হার কমেছে ৫০ শতাংশেরও বেশি


অসংক্রামক রোগ-ব্যাধি বাড়লেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে।  

 একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৩০ বছরে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে এবং স্বাস্থ্যের অগ্রগতির দিক থেকে দেশটি এই অঞ্চলে এগিয়ে রয়েছে। ভুটান, ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তান তথা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন সবচেয়ে বেশি।

 ১৯৯০ সাল থেকে ত্রিশ বছরেরও অধিক সময়ে বাংলাদেশে গড় আয়ু ৫৮.২ থেকে বেড়ে ৭৪.৬ বছরে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে বয়স অনুপাতে মৃত্যুর হার অর্ধেকে হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে, এই সময়ের মধ্যে মৃত্যুর হার অর্ধেকেরও বেশি কমেছে তথা ৫০ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে।

 “The burden of diseases and risk factors in Bangladesh, 1990–2019: a systematic analysis for the Global Burden of Disease Study 2019” শীর্ষক একটি নতুন গ্লোবাল বার্ডেন অফ ডিজিজ (জিবিডি) সমীক্ষার ফলাফল থেকে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

 বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে একদল গবেষক কর্তৃক পরিচালিত এই জিবিডি গবেষণার ফলাফল আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ’ (The Lancet Global Health) এ গবেষণা নিবন্ধ আকারে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।

 দ্য ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন (আইএইচএমই) এই জিবিডি গবেষণা পরিচালনা করে। আইএইচএমই হচ্ছে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটন- এর একটি উদ্যোগ।

জিবিডি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মৃত্যুর হার এবং স্বাস্থ্যের ক্ষতি অর্ধেকেরও বেশি হ্রাস করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে।

 ১৯৯০ থেকে ২০১৯, এই ত্রিশ বছরে বয়স অনুপাতে মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৫০৯ জন থেকে কমে ৭১৪ জন হয়েছে। গবেষণা বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বিগত ৩০ বছরে বাংলাদেশে বয়স অনুপাতে মৃত্যুর হার সবচেয়ে কম।

গবেষণা প্রবন্ধে আরো বলা হয়েছে, উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপানজনিত রোগ-সহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগে মৃত্যু প্রধান কারণগুলির মধ্যে ছিল। স্ট্রোক, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি অসংক্রামক রোগ বিগত এই সময়ে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে।

গবেষকরা তাদের প্রবন্ধে দেখান যে, অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও সিএমএনএন রোগ (সংক্রামক, মাতৃত্বকালীন, নবজাতক এবং পুষ্টিজনিত রোগ) কমার কারণে বাংলাদেশে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।

গবেষক দল সুপারিশ করেন যে, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং শহুরে ও গ্রামীণ উভয় পরিবেশে স্বাস্থ্যকর জীবনধারাকে উন্নীত করতে হবে। এজন্য কার্যকর বাজেট গ্রহণ ও বরাদ্দ এবং বহুমাত্রিক কর্মসূচি গ্রহণ ও কৌশল বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

গ্লোবাল বার্ডেন অফ ডিজিজ (জিবিডি) সমীক্ষা বাংলাদেশে রোগের বোঝা, প্রবণতা, মৃত্যুহার এবং পদ্ধতিগত বিশ্লেষণের একটি বিস্তৃত চিত্র প্রদান করেছে। বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কয়েকজন গবেষক ও বিশেষজ্ঞ বলেছেন, এই বিষয়ে এই গবেষণাই প্রথম।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক ড. দীপক কুমার মিত্র এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মলয় কান্তি মৃধা দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধটির প্রশংসা করে বলেন, এই ধরনের গবেষণা এই বিষয়ে প্রথম।

তাঁদের মতে, ”এই গবেষণার ফলাফল বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক এবং সংশ্লিষ্টদের স্বাস্থ্যের অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দিক নির্দেশনা প্রদান করবে। গবেষণাটি এই কারণে আরো সময়োপযোগী যে, বাংলাদেশ বর্তমানে স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা এবং পুষ্টি খাতের জন্য পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে।”

গবেষণাকর্ম ও এর ফলাফল নিয়ে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় গবেষণা দলের প্রধান এবং আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধের প্রধান লেখক ড. শরীফুল ইসলামের। ‍তিনি অস্ট্রেলিয়ার ডেকিন ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট ফর ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন (আইপিএএন)-এর একজন সহযোগী অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ হেলথ সায়েন্সেসের এনসিডি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।

ড. শরীফুল ইসলাম বলেন, উন্নত স্বাস্থ্য পরিষেবা, সরকারি অর্থায়নে ওষুধের প্রাপ্যতা সহজিকরণ এবং সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের জন্য টিকাদানের ফলে মা ও শিশু মৃত্যুর হার উন্নতির ফলাফল স্বরূপ বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে এই উন্নতি এবং গড় আয়ু বৃদ্ধি।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের বৃদ্ধি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। খাদ্যাভ্যাস, গ্রামীণ পরিবেশ থেকে শহরে স্থানান্তর, কৃষি থেকে অফিস-ভিত্তিক চাকরিতে বেশি হারে আগমন এবং স্বাস্থ্যসেবা সহায়তার অভাব ইত্যাদি কারণে মূলত অসংক্রামক রোগগুলোর প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। এই অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হবে।”

এই গবেষণার ফলাফল নিয়ে দৈনিক বাংলাদেশ পোস্টের সাথে আলাপকালে মন্তব্য করতে গিয়ে জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত আইন ও তামাক নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ এবং নীতি বিশ্লেষক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন বলেন, এটা ভালো খবর যে বাংলাদেশে গড় আয়ু বেড়েছে।

তিনি বলেন, “সুস্থতা ও আনন্দের সাথে গড় আয়ু উপভোগ করা দরকার। দেশে অংক্রামক রোগ ক্রমবর্ধমান হওয়ায় এর নিয়ন্ত্রণে জোর দেওয়া উচিত। এজন্য দূষণমুক্ত পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দূষণমুক্ত সুন্দর পরিবেশে মানুষ যেন সুস্থতার সাথে গড় আয়ু বৃদ্ধিকে উপভোগ করতে পারে।”

দ্য গ্লোবাল বার্ডেন অফ ডিজিজ (জিবিডি) পদ্ধতির অনুস্মরণে গবেষণাকর্মটি সম্পাদিত হয়েছে। এই গবেষণায় বাংলাদেশে রোগের বোঝা, প্রবণতা ও ঝুঁকির কারণগুলি বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

এ নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস (বিইউএইচএস) এর এনসিডি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পলাশ চন্দ্র বণিকের সাথে। তিনি এই গবেষণাকর্মে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধের অন্যতম লেখক।

পলাশ চন্দ্র বণিক এই প্রতিবেদককে বলেন, তাঁদের সম্পাদিত গবেষণাকর্মে বাংলাদেশ সরকার এবং অন্যান্য অংশীজনের দ্বারা নির্ধারিত অগ্রগতি পরিমাপ এবং লক্ষ্য অর্জনের তথ্য প্রদান করা হয়েছে।

এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই গবেষণার ফলাফল ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।