ন্যাভিগেশন মেনু

শীত মৌসুমকে কাজে লাগিয়ে ভেজাল গুড়ে সয়লাব বাজার


আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে নানান পীঠস্থান জুড়ে রয়েছে শীতকালে নানান রকমের পিঠার প্রচলন। অঞ্চলভেদে এসব পিঠার রয়েছে নানান সমৃদ্ধ  ইতিহাস ও জনপ্রিয়তা। সারা বছরে পিঠার চাহিদা থাকলেও ষড়ঋতুর এই বাংলাদেশে শীতকালে পিঠাপুলির চাহিদা যুগযুগ ধরে বহমান। নবান্নের নতুন ধানের ঘরে উঠলে একসময় গ্রামে গ্রামে পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যেতো।

কালের বিবর্তনে আমাদের যান্ত্রিক জীবন যাপনে সেসব  উৎসব হারিয়ে গেলেও শীতকালে পিঠাপুলির চাহিদা আজও থেকে গিয়েছে। আর এসব পিঠাপুলির উপাদান গুলোর মধ্যে গুড় বা মিঠাই অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। গুড়ের মূল উপাদান খেজুরের ও আখের রস হলেও বর্তমানে বাজারজাত প্রায় নব্বই ভাগ গুড়েই খেজুর বা আখের রসের কোনো অস্তিত্বই নেই। তার প্রধান কারণ সমূহের মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা, পর্যাপ্ত উৎপাদন ও সংরক্ষণের অভাব, আর সর্বোপরি আমাদের পূঁজি বাদী মনোভাব। লক্ষ করলে দেখা যায় খেজুর বা আখ উৎপাদনের বড় অংশ গ্রাম থেকে আাসার কথা থাকলেও গাছ নিধনের ফলে গ্রামে আর তেমন খেজুর গাছ ও চাষের অভাবে আখ ক্ষেত দেখা যায়না।আর যারা আগে এসব গুড় ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন তারা অনেকেই পর্যাপ্ত লোকবল, কাঁচামালের ও আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে এ পেশা ছাড়তে অনেকটা বাধ্য হয়েছেন।

তবে মনে প্রশ্ন আসতেই পারে বাজারে এত গুড় আসে কোত্থেকে? বাজার পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়, বাজারে বিক্রিত এসব খেজুর/আখের গুড় তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে না প্রকৃত খেজুর কিংবা আখের  রস। তার বদলে ব্যবহার করা হচ্ছে নষ্ট হয়ে যাওয়া ঝোলা গুড়,পরিত্যক্ত চিনির শিরা, হাইড্রোজ,কাপড়ের  রং, স্যাকারিন, ফিটকিরি ও চুনসহ ক্ষতিকর নানা রাসায়নিক উপাদান।

রবিবার নগরীর পাহাড়তলী ফইল্যাতলী বাজার, আগ্রাবাদ বাদামতলি, কর্ণফুলী মার্কেট, খাতুনগঞ্জের আসাদগঞ্জের মুখে, রেয়াজউদ্দিন বাজার চৈতন্যগলি, কোতোয়ালি মোড়, কোর্টবিল্ডিং, পাথরঘাটা, টেরিবাজার, স্টেশন রোডের ফলমণ্ডি, বহদ্দারহাটসহ বিভিন্নস্থানে ঘুরে প্রায় সর্বত্রই এসব ভেজাল গুড় বিক্রি হতে দেখা যায়।ক্রেতা হিসেবে ধনী থেকে গরিব সব শ্রেনী পেশার মানুষকেও দেখা যায়। বাজার ঘুরে দেখা যায় স্থানভেদে প্রতিকেজি 'খেজুরের রস' দিয়ে তৈরি তরল গুড় বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা, ঝোলা গুড় ৩০০, মালাই তৈরি খেজুর গুড় ৩৫০, বড় সাইজের খেজুর গুড় ২৪০-২৬০ টাকা,ছোট সাইজের পাটালি গুড় ২২০ গুড় ও নিম্নমানেরগুড় ১৮০ টাকা।ক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায় গুড়ের বিশুদ্ধতা নিয়ে তারাও চিন্তিত। কেননা এসব গুড়ে রয়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি।
 
নগরে আগ্রাবাদ সিজিও বিল্ডিং-১ এর সামনে অবস্থিত গুড়ের দোকানে বয়োবৃদ্ধ এক ক্রেতা ছাবিলা খাতুন হাস্যোজ্জল মুখে বলেন একসময় নানারবাড়িতে ছোটবেলায় গুড় বানাতে দেখেছি। সে গুড়ের স্বাদ ও গন্ধ আলাদা।আজও নাকে লেগে আছে।এসব গুড়ে ভেজাল জেনেও নিতে বাধ্য হচ্ছি,শীতে পিঠাপুলি না খেলে বাঙালির চলেনা।

এক ক্রেতা জসিম হোসেন বলেন, ফেনীতে প্রতি কেজি খেজুরের রস বিক্রি হচ্ছে ১৫০-২০০ টাকা। ৭ কেজিতে হয় এককেজি রাব বা তরল গুড়। কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে কেজি ৩০০-৯০০ টাকায়। কিভাবে সম্ভব? ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারে এসব গুড় মূলত আসে রাজশাহী, নাটোর, বাগেরহাট, নওগাঁ, পার্বত্য এলাকা রাঙামাটি, বান্দরবন থেকে। প্রকৃত মান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন  ব্যবসায়ীরাও। 

রেয়াজউদ্দিন বাজারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক গুড় ব্যবসায়ী বলেন, 'আমরা যেসব গুড় বিক্রি করছি তা চট্টগ্রামের বাইরে বিভিন্ন জেলা থেকে কেনা। তাই এসব গুড় কি দিয়ে তৈরি আমারও জানিনা।

কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসেন বলেন, গুড় শীতকালে বেশ চাহিদা বেড়ে যায়, সেকারনে অনেকেই এই গুড়ের ব্যবসায় ঢুকে যায়। আবার অনেকে ভেজাল ও মানহীন গুড় বিক্রির ব্যবসায় অনুপ্রবেশ করে ফলে ভেজালের ছড়াছড়ি। যেহেতু এইগুড়ের বিষয়ে সরকারের কোন কতৃপক্ষই তদারকি করে না, সেকারনে ভেজাল গুড়বিক্রি বন্ধ হয় না। বিএসটিআই ও ভোক্তা অধিদপ্তরের নিয়মিত তদরাকি বাড়ানো দরকার। স্থানীয় জেলা উপজেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিষয় টি তদারকি করতে পারে তাহলে ভেজাল গুড়ের কারবার থেকে মুক্তি পাবে।

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাজলের তত্ত্বাবধায়ক ও সিভিল সার্জন ডা. শেষ ফরুলে রাবী বলেন, 'আসল খেজুর গুড় স্বাস্থের জন্য ভালো ও উপাদয়। কিন্তু ভেজাল গুড় ল খেলে কিডনি ড্যামেজ, খাদ্যনালিতে করদার, আমাশয় ও লিভার ড্যামেজ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই মানুষকে এসব খাবার এড়িয়ে যেতে হবে।' চট্টগ্রাম জেলা নিরাপদ খাদ্য বিভাগ জানান, ভেজাল গুড়ের বিষয়ে আমরা অবগত আছি।

তবে ঢালাওভাবে বাজারের সব গুড়কে ভেজাল বলা যাবেনা পরীক্ষা ছাড়া। কেননা দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রচুর গুড় উৎপাদন হয় যা সারাদেশে বাজারজাত করা হয়।কিন্তু সধারণত চট্টগ্রামে এসব গুড় উৎপাদন হয় না। কিছু অসাধু লোক মিষ্টির দোকানের উচ্ছিষ্ট রস, রং ও ক্যমিক্যাল দিয়ে পাটালী গুড় সদৃশ বানায়।যা আমাদের অভিযানে প্রায়ই ধরা পড়ে। তাই ভেজাল গুড় উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ করতে মাঠ পর্যায়ে এখনো আমাদের মোবাইল কোর্ট কাজ করছে। আপনাদের কাছে তথ্য থাকলে অবশ্যই জানাবেন।