ন্যাভিগেশন মেনু

পুনর্ভবা নদীর সেকাল-একাল


দিনাজপুর পুনর্ভবা নদীর ইতিহাস অনেকের অজানা। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মরা জানে না এই নদীর ইতিহাস।

বৃহত্তর দিনাজপুর তথা দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় মিলে ছিল বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা। তখন দিনাজপুরে মোট নদী ছিল  ১৯টি।

দিনাজপুর জেলা প্রশাসক সূত্রে জানা যায়, ৭২৪ কিলোমিটার জুড়ে প্রবাহিত হয়েছে এই নদী, খাল এবং বিলগুলো।

এর মধ্যে দিনাজপুর উপজেলার খানসামার নদী আত্রাই, করতোয়া, ভূষিরবন্দর চিরিবন্দরের কাঁকড়া, বীরগঞ্জের ঢেপা, ২নং সুন্দরবন ইউপির গর্ভেশ্বরী, পার্বতীপুর বড় চন্ডীপুর ইউনিয়নের ছোট যমুনা, খনার ছাতিয়ান গড় বিলের ইছামতি, আটোয়ারি বিলের ভুল্লী, বীরগঞ্জ উপজেলার পলাশবাড়ী বিল পাথরকাটা, সাতোর বিল নর্ত, গড়েয়া ঠাকুরগাঁও’র ছোট ঢেপা, খানসামার শেওলাকুড়ি বিল বেলান, পার্বতীপুর পাটিকা ঘাট বিলের নলসীশা, বিরামপুর উপজেলার ধানপাড়া বিলের তুলসীগঙ্গা, জোদ মাধুব বিলের চিরি, কাহারোল ডাবোর ইউনিয়নের তেতুলিয়া তুলাই, নবাবগঞ্জ উপজেলার মাসুদপুর করতোয়া মাইলা, চিরিরবন্দর বিল ভেলামতি এবং ৭নং মোহাম্মদ ইউপি বীরগঞ্জ উপজেলার প্রণনগর এলাকার পুনর্ভবা নদী।

পুনর্ভবা নদীটি দিনাজপুর শহরের বালুয়াডাঙ্গার উপর দিয়ে বয়ে গেছে। কিন্তু রয়েছে গেছে এই নদীর অনেক অজানা ইতিহাস। কি ছিলো না এই নদীতে। ব্যবসা বাণিজ্যে এই এলাকা ছিলো দিনাজপুর জেলায় প্রথম।

কেনা-বেচা থেকে শুরু করে ছিল মাছ ধরার ইতিহাস। এই নদীতে তখনকার সময় প্রায় ৫ হাজারের চেয়ে বেশি মানুষ পুর্নভবা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো। অনেক জেলে পরিবার আজ বেঁচে নেই। কিন্তু যে জেলে পরিবারগুলো আছে তাদের কাছে জানা গেলো পুর্নভবা নদীর কিছু ইতিহাস।

জেলে ৯৮ বছর বয়সি করিম মিয়া আজও বেঁচে আছেন। পুনর্ভবা নদীর কথা জানতে চাওয়ায় তিনি কেঁদে ফেলেন। কান্নার কারণও রয়েছে তার। এই নদীতে বন্যায় ভেসে গেছে তার পরিবার এবং ঘরবাড়ি। হঠাৎপাড়া বালুয়াডাঙ্গার স্যাঁতস্যাঁতে ভাঙ্গা ঘরে এখন বসবাস তার। তার কাছে নতুন করে রঙিন হয়ে উঠলো দিনাজপুর জেলা শহরের পশ্চিম প্রান্তের এই পুনর্ভবা নদীর ইতিহাস।

আজকের বাংলাদেশ পোস্টকে তিনি বলেন, দিনাজপুর জেলার পূনর্ভবা (কাঞ্চন) নদীর উপর দিয়ে এক সময় ছুটে চলতো  নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার। ষাটের দশকে ভাটিয়ালী গানের সুরে পালতোলা নৌকা নিয়ে ছুটে চলা ভরা যৌবনা উত্তাল পূনর্ভবা (কাঞ্চন) নদীর বুকে এখন দোল খেতে দেখা যায় সবুজ ধানক্ষেত। খুব বেশি আগের কথা নয়। ষাটের দশক জুড়েই ভরা যৌবনা ছিল পূনর্ভবা (কাঞ্চন) নদী। আশির দশক থেকে ক্রমেই যৌবন হারাতে থাকে এ নদী।

এখন এসে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে নদীটির আর হারানোর কিছুই নেই। সেই অতীতে পূনর্ভবা নদীতে ঢেউয়ের তালে তালে চলাচল করতো অসংখ্য নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার। ভাটিয়ালী আর পল্লীগীতির সুরে মাঝিরা নৌকা নিয়ে ছুটে চলতো নদী কেন্দ্রিক ব্যবসাকেন্দ্রে। এ নদীকে ঘিরে বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা বড় বড় হাটবাজারে ব্যবসার জন্য ধান, পাট, আলু, বেগুন, সরিষা, কালাই, গমসহ নানান কৃষিপণ্য নিয়ে সওদাগররা নৌকার পাল তুলে মাঝিরা ছুটে চলতেন বিভিন্ন প্রান্তে।

অসংখ্য মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবন জীবিকার রাস্তা খুঁজে পেয়েছিলেন। নদীর পানি দিয়ে কৃষক দুই পাড়ের উর্বরা জমিতে ফসল ফলাতেন। সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। জীবিকার সন্ধানে নদী সংলগ্ন ও আশপাশ এলাকার অসংখ্য জেলে পরিবারের বসতি গড়ে উঠেছিলো। ছোট বড় নানা প্রজাতির মাছের অফুরন্ত উৎস ছিলো এই নদী। মাছ পাওয়া যেতো সারা বছর।

জীবিকার জন্য মাছের আশায় জেলেরা রাতদিন ডিঙ্গি নৌকায় জাল-দড়ি নিয়ে চষে বেড়াতেন নদীর এ প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ধরা পড়তো প্রচুর মাছ। সেই সোনালি দিন শেষে হয়ে গেছে অনেক আগেই।

সময় গড়িয়ে চলার সাথে সাথে সেই ভরা যৌবনা পূনর্ভবা (কাঞ্চন) নদী এখন মরা খালে পরিণত হওয়ায় পূনর্ভবা (কাঞ্চন) নদীর ধারে গড়ে ওঠা অসংখ্য হাটবাজার এখন হয়েছে বিরাণ অঞ্চল। কৃষি জমিগুলো পরিণত হয়েছে ধূ ধূ বালু চরে। জেলে পরিবারগুলো হয়ে গেছে বিলীন, আর সেই সময়ের ব্যবসা-বাণিজ্যের উৎসগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

এসবই এখন কালের সাক্ষী। ঐতিহ্যের দিক থেকে এ জেলার নদ-নদীগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল পূনর্ভবা (কাঞ্চন) নদী। ভৌগোলিকভাবে নদীটি ছিল চমৎকার অবস্থানে। নদীটি কোনদিন খনন ও ড্রেজিং করা হয়নি এমনকি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সরকারের নজর না দেওয়ার সুযোগে এক শ্রেণির দখলবাজ নদীটির অনেক স্থান দখলে নিয়ে খুশিমতো ভরাট করে ফেলেছে। কেউ কেউ বর্জ্য ফেলে দূষণ ও ভরাট অব্যাহত রেখেছে। অনেকে অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র থেকে বালু উত্তোলন ও পাড় কেটে মাটি বিক্রির প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে।

এ বিষয়ে পাানি উন্নয়ন বোর্ড নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ ফয়জুর রহমান বলেন, আমরা সরকারের নিকট নদী খনন ও ড্রেজিং এর জন্য প্রয়োজনীয় কাজগপত্র পাঠিয়েছি। শীঘ্রই নদী খননের কাজ শুরু হবে।

পুনর্ভবা নদীটি অনেকে কাঞ্চন নদী নামে চেনে ও জানে। নদীর সৌন্দর্য্য রক্ষার জন্য জেলা প্রশাসক মো. মাহামুদুল আলমের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, পুনর্ভবা নদীর ইতিহাসের এতো কথা আমার জানা ছিল না। আমি চেষ্টা করবো নদীটির হারানো সৌন্দর্য্যকে যেনো ফিরে আসে।

বর্তমানে দিনাজপুর পুবর্ভবা নদীটি কিছু অসাধু ব্যক্তি দখল করে বাড়িঘর নির্মাণ করেছেন। সুধী মহল তথা দিনাজপুরবাসীর প্রাণের দাবী, বৃহত্তর এই পুনর্ভবা নদীটি সংরক্ষণ, সৌন্দর্য বর্ধনসহ নদীটি দখলমুক্ত করার জন্য জেলা প্রশাসকের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। 

সিবি/এডিবি