ন্যাভিগেশন মেনু

যমুনার চরাঞ্চলে সবুজের সমারোহ


বর্ষাকালে অথৈ পানি। আর পানি শুকিয়ে গেলেই ধু ধু বালুচর। নদী অধ্যুষিত চরাঞ্চলগুলোর এটাই স্বাভাবিক চিত্র। শীর্ণ আর স্রোতহীন শান্ত এ নদী দেখে যমুনা নদীর প্রমত্তা রূপ কল্পনা করা কঠিন। যমুনার বুকে জেগে ওঠা বালুচরে কৃষিবিপ্লব ঘটিয়েছেন নদীভাঙা মানুষ।

নদীর চরে বিভিন্ন ফসল ফলিয়ে তারা অভাব অনটন দূর করছেন। নদীর বালুচরে ভাগ্য বদলের স্বপ্নবুনে ঘরে তুলে লাভবান হচ্ছেন খেটেখাওয়া মানুষ। বগুড়ার সারিয়াকান্দির যমুনার চরাঞ্চলে এখন চোখ ধাঁধানো বর্ণিল সবুজ ফসলের সরব উপস্থিতি। যমুনার বালুচরে পলিমাটি জমে এখন উর্বর আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে। বিস্তীর্ণ বালুচরে শোভা পাচ্ছে নানা রকম ফসল। নদীর তলদেশ শুকিয়ে জেগে ওঠে বালুচর। চরের জমি শস্যভান্ডার নামে পরিচিত।

এবার বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরপরই চরের চাষীরা নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে জমি চাষে সময় দিচ্ছেন। কাকডাকা ভোর থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে তাদের এই ব্যস্ততা। জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত চরাঞ্চলের জমিগুলোতে বন্যার কারণে পানি থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে দীর্ঘায়িত বন্যার কারণে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পানি ছিল। পানি কমে যাওয়ার সাথে সাথেই চাষিরা নতুন করে উর্বর চরের জমিতে চাষাবাদ শুরু করেছেন।

যমুনা নদীর তীরবর্তী সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনটের মধ্যে সারিয়াকান্দির চরাঞ্চল বেশি হওয়ায় ফসলও বেশি চাষাবাদ হয়। মরিচ, ভুট্টা ও পাটের পাশাপাশি ধান, গম, সরিষা, চিনাবাদাম, মিষ্টিকুমড়া, গোলআলু, মিষ্টিআলু, রসুন, পেঁয়াজ, কাউন, মশুরডাল ও খেসারিডালসহ প্রায় সবধরনের শাক-সবজি চাষাবাদ করেন কৃষকরা। তবে মরিচের চাষ বেশি হয়।

এবার চরাঞ্চলে সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর জমিতে দেশি ও হাইব্রিড জাতের মরিচ চাষ হয়েছে। প্রতি বিঘায় ৫০ থেকে ৭০ মণ মরিচ উৎপাদন হয়, জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে বগুড়ার চরাঞ্চলের লাল মরিচ। শুকনো আকারে মরিচের উৎপাদন হবে প্রায় ৭ হাজার মেট্রিকটন, আর কাঁচা আকারে ১৩ হাজার মেট্রিকটন। চাষীরা ইতোমধ্যেই মরিচ বাজারে বিক্রি শুরু করেছেন। প্রতিমণ ২ হাজার ৬০০ টাকা দরে এসব কাঁচামরিচ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে। চরাঞ্চলের ২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা ও ২ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়ে থাকে। চরাঞ্চলের ১৬ হাজার ৭৩৩ হেক্টর জমিতে ফসল ফলান কৃষকরা।

একটি ফসল ঘরে তুলে আবারও নতুন করে ফসল ফলাতে জমি পরিচর্যার কাজ শুরু করেন কৃষকরা। নদীভাঙা অভাবী শত শত পরিবার নদীর বুকে জেগে ওঠা বালুচরকে কাজে লাগিয়ে অভাব দূর করছেন। এসব পরিবারের নারীরা তাদের স্বামী-সন্তান নিয়ে পরিশ্রম করে ফসল ফলাচ্ছেন। সেই ফসল বিক্রি করে সফলতা পাচ্ছেন।

কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সুত্রে জানা গেছে, সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ি, হাটবাড়ি, ফাজিলপুর, তেলীগাড়ি, গওলাডাঙ্গা, মানিকদাইড়, আউচারপাড়া, কাকালিহাটা, সবুজের পাড়া, চক রথিনাথ,  দিঘাপাড়া,  করনজা পাড়া, বনর পাড়া , কাজলা,  জামথল, পাকুরিয়া,  উত্তর টেংরাকুরা, চরঘাগুয়া, নব্বইয়ের চর, কটাপুর, বেড়া পাঁচবাড়িয়া,  কুড়িপাড়া, বাওইটোনা,  উত্তর বেনিপুর,  দক্ষিণ বেনিপুর, চরবাটিয়া, চিলাপাড়া,  চরপাড়া, মথুরাপাড়া,  ইন্দুরমারা, ডাকাত মারা, মূলবাড়ি, ধারাবর্ষা, শংকরপুর,  কমরপুর, মাঝবাড়ি,  মাঝিয়া,  হাতিয়াবাড়ি,  এবং পৌতিবাড়ি চরে চাষাবাদ হয়।

এছাড়া সোনাতলা উপজেলার পাকুলা পূর্ব সুজাইতপুর, খাটিয়ামারী, রাধাকান্তপুর, তেকানী চুকাইনগর ইউনিয়নের চরমোহনপুর, সরলিয়া, ভিকনেরপাড়া, চুকাইনগর, খাবুলিয়া, জন্তিয়ারপাড়া, দাউদিয়ারপাড়া, সোনাতলা সদর ইউনিয়নের নামাজখালী, রংরারপাড়া, কামালেরপাড়া, জোড়গাছা ইউনিয়নের কুশাহাটা, পারবগা, সর্জনপাড়া, উত্তর বয়ড়া (আংশিক), মধুপুর ইউনিয়নের চর মধুপুর ও চর চকনন্দন চরে চাষাবাদ হয়।

এ চরগুলোর মানুষের জীবন-জীবিকার প্রধান মাধ্যম কৃষিকাজ ও মাছ ধরা। বংশ পরম্পরায় চরে থাকা এ চিরসংগ্রামী মানুষগুলো নিজেদের পরিশ্রমে আর সরকারের সার্বিক সহায়তায় ধু ধু বালিতে সোনা ফলাচ্ছেন। সারিয়াকান্দি ও সোনাতলার চরাঞ্চলগুলোতে তাকালেই চোখে পড়ে সবুজের সমারোহ। চরের ইঞ্চি ইঞ্চি মাটির সদ্ব্যবহার করে পরম যত্নে এখন তারা আধুনিক পদ্ধতিতে সেখানে ফলাচ্ছেন ধান, গম, ভুট্টা, মরিচ, পাট, সরিষা, চিনা বাদাম, আলু, মিষ্টিআলু, সবজি, মশুরডাল ও খেসারি ডাল।

সোনাতলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা, ১ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান, ৩৬০ হেক্টর জমিতে গম, ৩০৫ হেক্টর জমিতে সরিষা, ৮৫০ হেক্টর জমিতে মরিচ, ২৭০ হেক্টর জমিতে আলু, ১৫ হেক্টর জমিতে মিষ্টিআলু, ২৫ হেক্টর জমিতে চিনাবাদাম, ৬০ হেক্টর জমিতে মশুরডাল, ১৭০ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হচ্ছে।

সোনাতলা উপজেলা কৃষি অফিসার মাসুদ আহম্মেদ আজকের বাংলাদেশ পোস্টকে জানান, ‘সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ শুরু করেছে। চরাঞ্চলগুলোতেও প্রযুক্তিনির্ভর উন্নত জাতের বীজের মাধ্যমে চাষাবাদ শুরু হয়েছে। যার ফলে প্রতিবছর চরাঞ্চলগুলোতে কৃষি সম্প্রসারিত হচ্ছে, বাড়ছে উৎপাদন।

সারিয়াকান্দির ৩ হাজার ৭০৫ হেক্টর জমিতে মরিচ, ৭০৫ হেক্টর জমিতে শাকসবজি, ৯৫০ হেক্টর জমিতে আলু, সরিষা ২ হাজার ৭৮০ হেক্টর জমিতে, ১ হাজার ৩২০ হেক্টর জমিতে গম, ৩ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা, ১০ হেক্টর জমিতে আখ, ৪৫ হেক্টর জমিতে রসুন, ৩ হাজার ৭০৫ হেক্টর জমিতে মরিচ, ৮৪০ হেক্টর জমিতে মসুর, ৮৫০ হেক্টর জমিতে খেসারিসহ মিষ্টিআলু, চিনাবাদাম, খেরাছী, কেসুরআলু, পিঁয়াজ, কলা, পেঁপে চাষ হয়েছে।

মরিচ চাষের জন্য বিখ্যাত বগুড়া সারিয়াকান্দি যমুনার চরের বিস্তীর্ণ এলাকাগুলো সবুজে সেজে উঠেছে। যেদিকে চোখ যাবে সেদিকেই দেখা যাবে মরিচ ক্ষেতের নয়নাভিরাম দৃশ্য। মরিচ ক্ষেতের যত্নে কৃষকরা সর্বদাই প্রস্তুত রয়েছেন। জমিতে নিরানি দেওয়া, শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি দেওয়া, সার প্রয়োগ করা ইত্যাদি কাজে তারা ব্যস্ত সময় পার করছেন। পুরো সারিয়াকান্দিতে মরিচের চাষ হলেও চরগুলোতে মরিচের ফলন সবচেয়ে বেশি হয়।

কাজলা কুড়িপাড়া চরের মরিচ চাষি শহিদুল ইসলাম আজকের বাংলাদেশ পোস্টকে জানান, গতবছর প্রতিবিঘা জমি হতে আমি প্রায় ৫০ মণ কাঁচামরিচ পেয়েছি। এ বছরের গাছে ভালোই মরিচ ধরেছে। সবেমাত্র মরিচ তুলতে শুরু করেছি। বাজারে ভালো দাম পাওয়ায় এবারের সবচেয়ে বেশি লাভের আশা করছি।

তরুন কৃষি উদ্যোক্তা সাহাদত জামান আজকের বাংলাদেশ পোস্টকে জানান, তিনি কয়েক বছর ধরেই মরিচ চাষ করছেন। দেশি জাতের মরিচ প্রতি বিঘায় ৫০ মণ এবং হাইব্রডি জাতের প্রতি বিঘায় ৭০ মণ পর্যন্ত মরিচ পাওয়া যায়। মরিচ চাষে লাভ হওয়ায় এ এলাকার চাষীরা বেশি আগ্রহী হচ্ছেন।

সারিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল হালিম আজকের বাংলাদেশ পোস্টকে জানান, চলতি বছরে জমিতে দীর্ঘসময় বন্যার পানি থাকায় মরিচ গাছে রোগ জীবাণু কম। ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ কম হয়েছে। উৎপাদন বেশি হয়েছে। কৃষি কর্মকর্তারা নিয়মিত পরামর্শ দিচ্ছেন চাষীদের। এ এলাকার চাষীরা চরাঞ্চলে সবজিসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করছেন। গোটা চরাঞ্চল যেনো সবুজের সমারোহ।

এএসবি/সিবি/এডিবি