ন্যাভিগেশন মেনু

যে পল্লীতে ৫০ বছরে কেউ এসএসসি পাস করেনি


পাবনার চাটমোহরের নিমাইচড়া ইউনিয়নের করকোলা ঋষিপল্লী। এই পল্লীর শতভাগ শিক্ষার্থী লেখাপড়ায় ঝরে পরছে। গত ৫০ বছরে এ পল্লীতে  কেউ এসএসসি পাশ করেনি।

সরকার যখন উপবৃত্তি দিচ্ছে, বিনামূল্যে বই দিচ্ছে এমন সময়ও এ পল্লীর কোনো ছেলে বা মেয়ে পড়াশোনায় এগোতে পারছে না। ফলে দিনের পর দিন এ ঋষিপল্লীর মানুষগুলো অনগ্রসর রয়ে যাচ্ছে।

চাটমোহর পৌর সদর থেকে ৬ কিলোমিটার উত্তরে করকোলা গ্রামের অবস্থান। এ গ্রামের পূর্বাংশে ঋষিপল্লীটি অবস্থিত।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুসলমানদের পাশাপাশি সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে এ গ্রামে বর্তমান ঋষি সম্প্রদায়ের ১০৫টি পরিবার বসবাস করছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, গত অর্ধশতাব্দীতে লেখাপড়ায় অনগ্রসর এ ঋষিপল্লীর কেউই এসএসসি পাস করতে পারেনি। এ পল্লীর মৃত খগেন্দ্র নাথ দাস ওরফে খোকা দাসের ছেলে ক্ষিতিশ চন্দ্র দাস (৭১) সর্বশেষ ১৯৭০ সালে মেট্রিক পাস করেন।

যেহেতু ক্ষিতিশ চন্দ্র দাস এ পল্লীর একমাত্র শিক্ষিত ব্যক্তি তাই পল্লীর সকলেই তাকে মান্য করেন। এ পল্লীর নেতৃত্বে দেন তিনি।

ক্ষিতিশ চন্দ্র দাস আজকের বাংলাদেশ পোস্টকে জানান, ‘বৃটিশ আমল থেকে এ গ্রামে ঋষিদের বসবাস। ১৯৭০ সালে আমি মেট্রিক পাস করি। এর পর এ পল্লীর আর কেউ এসএসসি পাস করেনি। এখন প্রায় সব শিশুই স্কুলে যায়। ফাইভ, সিক্স, সেভেন এসব ক্লাসে পড়ার সময় বিভিন্ন কারণে ঝরে পরছে তারা। বারো-তেরো বছর বয়সে এসে কিশোররা লেখাপড়া বাদ দিয়ে সেলুনের কাজ, জুতার কাজ, বেতের কাজ, দর্জির কাজসহ বিভিন্ন কাজে যুক্ত হচ্ছে। মেয়েরা মায়েদের সাথে বাঁশের কুটির শিল্পের কাজ করছে। অভিভাবকরা অপেক্ষাকৃত কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। মূলত অভিভাবকদের অসচেতনতা ও অর্থের অভাবে তারা আর পড়ালেখা করছে না। বর্তমান এ পল্লীতে ৬০ থেকে ৭০ জন স্কুলে যাওয়ার উপযোগী ছেলে মেয়ে রয়েছে। এরা স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মন্দিরভিত্তিক শিশুশিক্ষা কেন্দ্র ও পাশের স্কুলগুলোতে পড়ালেখা করে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকে তো স্কুলগুলো পুরোপুরি বন্ধই রয়েছে। অনেকেই পড়ালেখা শুরু করে কিন্তু কেউই টিকে থাকে না।’

নরসুন্দর পেশায় নিয়োজিত শ্রীপদ দাস (৪০) বলেন, ‘নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে এখন এলাকায় সেলুন করেছি। আমাদের ছেলে মেয়েরা স্কুলে গেলেও কাজ করার উপযোগী হলে সবাই কাজে ঢুকছে। কেউ বেশি পড়ালেখা করছে না। মেয়েদেরকে অপেক্ষাকৃত কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দেন অভিভাবকেরা। কিছু মহিলা দর্জির কাজ ও কুটির শিল্পের কাজ করেন। ছেলেদের বেশির ভাগই নরসুন্দর পেশায় সম্পৃক্ত হয়।’

অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা করকোলা ঋষিপল্লী। ৬ বিঘার মতো জমিতে ১০৫ পরিবার গাদাগাদি করে বসবাস করছে কোনো মতে। পল্লীর প্রায় চারপাশেই খাল। দক্ষিণ পাশে কাঁচা মাটির রাস্তা। রাস্তায় ওঠার জন্য কয়েক বছর আগে পূর্ব-উত্তর পাশের খালের উপর স্থানীয় চেয়ারম্যান কালভার্ট করে দিয়েছিলেন। কেউ এক শতক কেউ দুই শতক এরকম পরিমান জায়গার উপর বাড়ি করে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। মাঠে কারো কোনো জমি নাই। জমি চাষ করেন না কেউই। কয়েক বছর আগে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ঋষিপল্লীর জন্য একটি কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। এখন কমিউনিটির মিটিং হয় এ সেন্টারে। কমিউনিটি সেন্টারের পাশেই অবস্থিত দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির। এখানেই কালী পূজা, দূর্গা পূজা, মহাদেব পূজা, স্বরস্বতী পূজাসহ অন্যান্য পূজা অর্চণার কাজ সারেন ঋষি পল্লীর নারী পুরুষ।

এ প্রসঙ্গে উপজেলা শিক্ষা অফিসার খন্দকার মাহবুবুর রহমান আজকের বাংলাদেশ পোস্টকে জানান, ‘৪ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা এবং ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের ৫ বছর মেয়াদী প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। এ ব্যাপারে উক্ত এলাকার প্রতিষ্ঠান প্রধান, সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা, স্কুল পরিচালনা কমিটির সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঝরেপড়া রোধকল্পে প্রয়োজনে অতিরিক্ত হোম ভিজিট, অভিভাবক সমাবেশ এবং অভিভাবকদের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ বৃদ্ধি করে শিক্ষার্থী ঝরেপড়া রোধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈকত ইসলাম বলেন, ‘উপজেলার মধ্যকার একটি ঋষিপল্লী শিক্ষায় এতটা পিছিয়ে রয়েছে বিষয়টি আমার জানা ছিলো না। এ ব্যাপারে উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের সাথে কথা বলে প্রয়োজনে অতিরিক্ত নজরদারি করা হবে। শিক্ষায় ঝরেপড়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

সিবি/এডিবি