ন্যাভিগেশন মেনু

মুক্তিপণের মাধ্যমে জলদস্যুদরে কবল থেকে মুক্তি পেল এমভি আবদুল্লাহ'র ২৩ নাবিক


দীর্ঘ ৩১ দিন পর সোমালিয়ান জলদস্যুদের কাছর বন্দি থাকা বাংলাদেশি ২৩ নাবিক মুক্তি পেয়েছে।  সেজন্য তিন বস্তা ডলার  মুক্তিপণ নিয়েই বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর ২৩ নাবিককে মুক্তি দিয়েছে। তবে মুক্তিপণের পরিমাণ জানানো যাবে না বলে জানিয়েছেন মালিকপক্ষ। 

ডলারভর্তি এসব ব্যাগ পাওয়ার পর বাংলাদেশ সময় শনিবার দিবাগত রাত ৩টা ১০ মিনিটে জাহাজটি থেকে দস্যুরা নেমে যায়। 

মুক্তিপণের বিষয়টি গোপন রেখেছেন তিনটি পক্ষ। একপক্ষ জাহাজটি জিম্মি রাখা সোমালিয়ার দস্যুরা, দ্বিতীয়ক্ষ কেএসআরএম গ্রুপে মালিকানাধীন মালিকপক্ষ এবং তিনপক্ষ লন্ডনভিত্তিক জাহাজের বিমা কোম্পানি।  
একই কোম্পানীর মালিকাকাধীন জাহাজ জাহান মণি উদ্ধারের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে একই উপায়ে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত করল এমভি আবদুল্লাহ'র নাবিকদের।  এতে দরকষাকষি শেষে দস্যুদের সঙ্গে সমঝোতায় একমাস পর মুক্তি মিলেছে। 

এর আগে রবিবার (১৪ এপ্রিল) ভোর রাত ৪টায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কেএসআরএম’র মিডিয়া অ্যাডভাইজর মিজানুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ২৩ নাবিকসহ আমাদের জাহাজটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। নাবিকরা অক্ষত অবস্থায় আমরা ফেরত পেয়েছি। 
পরে দুপুর ১২টায় কেএসআরএম প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন বিস্তারিত জানান কেএসআরেম গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) সরোয়ার জাহান, কেএসআরএম গ্রুপের সিইও মেহেরুল করিম উদ্দিন, পরিচালক করিম উদ্দিন, মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম 

ডিএমডি শাহরিয়ার জাহান রাহাত বলেন, জাহাজের উপরে লাইন ধরে দাঁড় করানো হয় নাবিকদের। এরপর জাহাজ থেকে ডলারভর্তি ৩টি ব্যাগ সাগরে ফেলে দেওয়া হয়। স্পিডবোট দিয়ে কুড়িয়ে নেওয়ার পর জাহাজে উঠে দস্যুরা। তাদের দাবি অনুযায়ী ডলার পাওয়ার পর জাহাজটি ছেড়ে দেয়। জাহান মণি জাহাজ জলদস্যুর কবলে পড়ার ১৪ বছর পর আমরা একই ঘটনা সম্মুখীন হলাম। গত ১২ মার্চ অস্ত্রের মুখে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি আক্রমণের শিকার হয়েছিল। দীর্ঘ ৩১ দিন পর জলদস্যুরা জাহাজটি ছেড়ে দেয়। সাধারণত দস্যুরা মালিকপক্ষকে টার্গেট করে বেশি স্বার্থ হাসিল করতে চায়। আমরা তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে জাহাজ ও নাবিকদের উদ্ধারে আলোচনা শুরু করি। আমাদের জাহাজ হাইরিস্ক এরিয়ার বাইরে ছিল। ২০০ নটিক্যাল মাইল রিস্কি। আমরা ৬০০ নাটিক্যাল মাইলে ছিলাম। তাই আর্ম গার্ড নিইনি আমরা।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ধন্যবাদ জানাতে চাই। বিদেশি যুদ্ধজাহাজ ফোর্সফুলি জাহাজটি উদ্ধারে যেতে চেয়েছিল। আমাদের সরকার কুইক রেসপন্স করেছে। সাংবাদিকরা সহযোগিতা করেছেন। জাহাজটি ১৯-২০ এপ্রিল সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাবে। এরপর নাবিকদের দেশে ফিরিয়ে আনাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তারা ফ্লাইটে, পরে ওই জাহাজেই দেশে ফিরতে পারবেন।  

কেএসআরএম গ্রুপের সিইও মেহেরুল করিম বলেন, ১৩ বছর আগে আমাদের আরেকটি জাহাজ জাহানমণি জিম্মি হয়েছিল। জাহান মণির সময় আমাদের জ্ঞানের অভাব ছিল। তখন উদ্ধারে সময় বেশি লেগেছিল। এবার জাহাজ দখলে নেওয়ার পর আমরা জাহাজের লোকেশন ট্রেক করতে থাকি। যোগাযোগ শুরুর পর প্রতিদিনই কথা হচ্ছিল। নাবিকরা কেমন আছে, কত তাড়াতাড়ি দস্যুরা জাহাজ ছেড়ে যাবে ইত্যাদি। দুই দিন আগে আমাদের দাবি ছিল, তাই প্রত্যেক নাবিকের ভিডিও নিয়েছি। মুক্তিপণের প্রতিটি কাজ আইনগতভাবে করা হয়েছে। একজন কমান্ডার যিনি ইংরেজি বলতে পারেন, তিনি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারপর থেকে আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল জাহাজের নাবিকেরা সুস্থ আছেন কিনা তা নিশ্চিত করা। আমরা যেহেতু ইন্টারন্যাশনাল শিপিংয়ের সঙ্গে জড়িত, তাই প্রতিটি রুল আমাদের মেনে চলতে হয়। এবারও বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। প্রতিদিন জুমে কথা বলে আপডেটগুলো জানাতে হতো। আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে করা হয়েছে৷ কত ডলার সে বিষয়টি আমরা নানা কারণে বলতে পারছি না। কেনিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও সোমালিয়ার আইন অনুয়ায়ী জাহাজটি সমঝোতার সব প্রক্রিয়া বৈধভাবে হয়েছে। সমঝোতার শর্ত অনুযায়ী অনেক বিষয় প্রকাশ করতে পারব না আমরা।

তিনি বলেন, নাবিকদের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত কথা হতো। পরিবারের সঙ্গেও তাদের নিয়মিত কথাবার্তা হয়েছে। আমরা জানতাম, নাবিকরা সবাই সুস্থ আছেন, অক্ষত আছেন। 

তিনি বলেন, সর্বশেষ আমরা যখন মুক্তির প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করি, দুইদিন আগে ভিডিও পাঠাতে বলি, সকল নাবিক কেমন আছে, কী অবস্থায় আছেন। ভিডিও পাঠিয়ে আমাদের সর্বশেষ অবস্থা জানানো হয়। এভাবে ৩০টা দিন আমরা যোগাযোগ রেখেছি। রবিবার ভোর তিনটায় কথা হয় ক্যাপ্টেন সঙ্গে, জলদস্যুরা ৬৫ জন ছিল। বোটে করে তারা চলে যায়। সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার পর দুবাইয়ের পথে এমভি আবদুল্লাহ। দুবাইতে কয়লা খালাসের পর সেখানে জাহাজের দায়িত্ব নিবেন নাবিকরা। সব প্রক্রিয়া শেষ করে তাদের দেশে ফিরতে সময় লাগতে পারে আরো সপ্তাহ লাগবে। আগামী ১৯ এপ্রিল নাবিকরা দুবাই পৌঁছার কথা রয়েছে। এরপর ২০ এপ্রিল সরাসরি বিমানে চট্টগ্রামে পৌঁছাবেন।

তিনি বলেন, সবাই একটা কথা সবসময় বলে আসছে, কেন আমরা আর্মড গার্ড নেইনি। এটার কারণ হচ্ছে আমরা হাই রিস্ক অ্যারিয়ার বাইরে ছিলাম। সাধারণত ২০০ নটিক্যাল মাইলের ভেতর হাইরিস্ক অ্যারিয়া হিসেব করা হয়। কিন্তু আমরা যাচ্ছিলাম মোটামুটি ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে দিয়ে। গত ৮-৯ বছরে ওই এলাকায় এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি, যেখানে আর্মড গার্ড নিতে হয়। একারণে আমরা আর্মড গার্ড নেইনি।

এর আগে গত ১২ মার্চ মোজাম্বিকের মাপুতু বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটিকে নিয়ন্ত্রণ নেয় সোমালিয়ার জলদস্যুরা। জাহাজটিতে ৫৫ হাজার টন কয়লা রয়েছে। জাহাজে থাকা ২৩ নাবিকের সবাই বাংলাদেশি। জাহাজটি চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এস আর শিপিং লিমিটেডের মালিকানাধীন।

নাবিকেরা হলেন- জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ এবং ক্রু মো. আনোয়ারুল হক, মো. আসিফুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসেন, জয় মাহমুদ, মো. নাজমুল হক, আইনুল হক, মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, মো. আলী হোসেন, মোশাররফ হোসেন শাকিল, মো. শরিফুল ইসলাম, মো. নুরুদ্দিন ও মো. সালেহ আহমদ।