ন্যাভিগেশন মেনু

ঐতিহ্য হারাচ্ছে জীবননগরের মিষ্টি পান!


বাংলার প্রায় প্রতিটি ঘরেই পান খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। কেউ অভ্যাস করে, কেউ বা শখ করে পান খেয়ে থাকেন। কৃষিনির্ভর এই দেশে পান একসময় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণ্য হতো। বিশেষ করে বাসাবাড়িতে মেহমান বা আত্মীয়-স্বজন এলে তাদের সর্বপ্রথম আপ্যায়ন করা হতো পান দিয়ে। পান ছাড়া বিয়ে-শাদি বা পূজা-পার্বণ হতো না।

আমাদের পূর্বপুরুষরাও বিশ্বাস করতেন বাড়ি থেকে মেহমান খালি মুখে বিদায় হলে গৃহস্থের অমঙ্গল হয়। তাই আর কিছু না হোক একটা পান খাওয়ানো চাই। মিষ্টি পানের জন্য জীবননগরসহ চুয়াডাঙ্গার খ্যাতি আছে। একসময় চুয়াডাঙ্গার পান চলে যেতো ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। তবে কালের বিবর্তনে চুয়াডাঙ্গায় পানচাষে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।

সরেজমিন পানের বরজ (পানক্ষেত) ঘুরে পানচাষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের দুর্দিন চলছে। পান বরজের প্রয়োজনীয় উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি, সময়মতো অর্থের জোগান না পাওয়া, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, উৎপাদিত পণ্যের উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ার কারণে জীবননগরে প্রয়োজনের তুলনায় নতুন করে পান চাষ হচ্ছে না। এতে জীবননগরসহ চুয়াডাঙ্গার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি পান তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। অনেকে পান চাষ ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশা ও ব্যবসায় চলে যাচ্ছেন।

পানচাষীরা জানান, পান চাষের মতো জটিল ও কষ্টসাধ্য আবাদে বর্তমানে দক্ষ শ্রমিক সহজে খুব একটা পাওয়া যায় না। এক হেক্টর জমিতে দৈনিক কমপক্ষে ১০ জন দক্ষ শ্রমিকের দরকার হয়। আর একজন দক্ষ শ্রমিকের দৈনিক হাজিরা কমপক্ষে ৫০০ টাকা হারে দিতে হয়। এতে এক হেক্টর জমিতে দৈনিক খরচ হয় পঁচ হাজার টাকা। বর্তমানে এক বিঘা জমিতে পান চাষ করতে যে পরিমান খরচ হয়, সে তুলনায় উৎপাদিত পানের মূল্য কম হওয়ায় তারা লাভবান হতে পারছেন না।

তারা জানান, প্রয়োজনীয় বাঁশ, পাটখড়ি, তার, লোহা, খৈল, কুটা ইত্যাদি উপকরণের মূল্য গত ১০ বছরে ২০০ গুণ বেড়েছে। অথচ পানের দাম সে অনুপাতে বাড়েনি। এক হেক্টর জমিতে বছরে প্রায় চার লাখ টাকার বাঁশ প্রয়োজন। বাঁশের মূল্য বৃদ্ধি, সার ও কীটনাশকের মূল্য চড়া এবং পরিবহন ব্যয়ও বেড়েছে। সবমিলিয়ে পানচাষীরা পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য পান চাষ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন।

জীবননগর উপজেলার বেশ কয়েকজন পানচাষীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ৭০-এর দশকে জেলায় পানচাষ শুরু হয়। ৯০ দশক পর্যন্ত জেলার পানের উৎপাদন ছিল আশানুরূপ। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত পানচাষে কিছুটা ভাটা পড়লেও ২০০১ সাল থেকে পানচাষীরা পানের উৎপাদনে আবার আশার আলো দেখতে পান। কিন্তু ২০১৫ সালের পর থেকে বিভিন্ন উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় পানচাষে মন্দাভাব নেমে আসে। ফলে সেই থেকে জেলায় আর পানচাষ বাড়েনি।

চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেব মতে, জেলায় বর্তমানে ১ হাজার ৬০৭ হেক্টর জমিতে পানের আবাদ রয়েছে। এরমধ্যে আলমডাঙ্গা উপজেলায় ৭৫০ হেক্টর, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় ৫১০ হেক্টর, দামুড়হুদা উপজেলায় ২৮৭ হেক্টর এবং জীবননগর উপজেলায় ৬০ হেক্টর। এসব জমিতে ছোটবড় চার হাজার বরজ রয়েছে। ১৩ হাজার ৪০০ জন কৃষক পানচাষের সঙ্গে জড়িত। এ ফসলের সঙ্গে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা সম্পৃক্ত। জেলার আলমডাঙ্গা ও সদর উপজেলায় পানের বেশি আবাদ হয়।

জীবননগর উপজেলার উথলী গ্রামের পানচাষী লিয়াকত আলী জানান, ৩৩ শতকের একবিঘা জমিতে পানের বরজ করতে প্রথমে জমি তৈরি করতে হয়। তারপর পানের বরজ চারদিকে ঘরের মতো বেড়া দিয়ে তার ওপরে ধানের বিচালি বা খড় দিয়ে ছাউনি দিতে হয় যাতে করে রোদ, বৃষ্টি, কুয়াশা ও পাখি থেকে পানকে রক্ষা করা যায়। এরপর জিবলে গাছের ডাল (নলা) বা বাঁশের শলি, পাটখড়ির শলা দিতে হয়। তারপর পানের লতা লাগাতে হয়। একবিঘা জমিতে বছরে পান উৎপাদন, রক্ষণাবেক্ষণ ও শ্রমিকের খরচ পড়ে এক লাখ টাকার মতো। আর উৎপাদিত পান দেড় থেকে দুইলাখ টাকায় বিক্রি হয়।

জীবননগর উপজেলার একতারপুর গ্রামের সেলিম হাসেন জানান, নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে পানচাষে কৃষকরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। অনেকেই জীবন-জীবিকার তাগিদে পারিবারিক ঐতিহ্য ছেড়ে অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। 

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, তাদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসেনি। প্রাচীন আমল থেকে এ পর্যন্ত পানচাষে যেটুকু সফলতা অর্জন হয়েছে তার সবটুকু কৃষকদের ব্যক্তিগত মেধা এবং তাদের নিজস্ব পরিকল্পনায়। পানচাষে সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা এবং ঋণ সুবিধা না থাকায় অর্থকরী ফসল পানের চাষ চুয়াডাঙ্গায় ক্রমান্বয়ে বিলুপ্তির পথে।

উথলী গ্রামের পানচাষী জাবেদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষরা পানচাষ করে আসছিলো। তা ধরে রাখার জন্য আজও পানচাষ করছি। পাঁচশত টাকার নিচে একজন শ্রমিক পাওয়া যায় না। পানচাষ করার জন্য যেসব উপকরণ দরকার তার দাম অনেক বেশি। পানের বরজে যা খরচ করি তার সিংহভাগও পান বিক্রি করে পাই না। ভাবছি পান চাষ ছেড়ে দেবো।’

অনন্তপুর গ্রামের পানচাষী মাজেদুর রহমান বলেন, এক পন (৮০টি) বড় পান চলতি বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে বিক্রি হয়েছে ৩০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকায়। কিন্তু বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা থেকে ১৫০ টাকায়। আর ছোট যে পান ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে সেই পান এখন বিক্রি হচ্ছে পনপ্রতি ৭০ টাকা দরে।

তিনি বলেন, কয়েকগুণ লোকসান গুনে পান বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে মূলধন তুলতেই আমরা হিমশিম খাচ্ছি।

‘সরকার ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্পসুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা করলে পানাচাষে চাষিরা আবার আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন। কারণ পানচাষ লাভজনক বলেই বিগত দিনে বারবার ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে এবং নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করেও কৃষকরা পুনরায় পানচাষে ফিরে এসেছেন।’

একতারপুর গ্রামের আমিনুল ইসলাম জানান, পানের তিনটি প্রধান রোগ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হয়। এগুলো হলো চর্ম, কালিয়ানা ও ওমোদিয়া। এসব রোগের প্রতিকার খুবই ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য। তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘বর্তমান সরকার বিভিন্ন খাতে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। বিভিন্ন আধুনিক কৃষি উপকরণ সুলভ মূল্যে তা সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় পানচাষের ক্ষেত্রে সরকার খুবই উদাসীন।’

উপজেলার পানচাষিরা বলছেন, চুয়াডাঙ্গার পানের ঐতিহ্য ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। রোগবালাই, বৈরী আবহাওয়া, পাতাপচা, পাতার ক্ষত, লতাপচা প্রভৃতি রোগের কারণে পান নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে পান আবাদের খরচও বেড়ে গেছে। পানের জন্য কৃষি বিভাগ থেকে কোনো সার, কীটনাশক সুবিধা দেওয়া হয় না। পানচাষিদের একটাই দাবি, সরকারি বা বেসরকারি সংগঠনগুলো যেন ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে তাদের ভাগ্যোন্নয়নে এগিয়ে আসে। পাশাপশি আধুনিক কৃষিতথ্য দিয়ে তাদের আরও উদ্বুদ্ধ করে। তাহলেই পান উৎপাদনের মাধ্যম অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করা যাবে।

তবে জীবননগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন আক্তার আজকের বাংলাদেশ পোস্টকে জানান, কেউ তাদের কাছে পোকামাকড় দমন বা অন্য কোনো সহযোগিতা চাইলে তাদের সবধরনের সহযোগিতা করা হয়ে থাকে।

চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আলী হাসান জানান, চলতি বছরে চুয়াডাঙ্গায় ১ হাজার ৬০৭ হেক্টর জমিতে পান আবাদ রয়েছে। এ আবাদের সঙ্গে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ জড়িত রয়েছেন। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ দক্ষ শ্রমিকের অভাব এবং অন্যান আবাদে লাভ বেশি হওয়ায় চুয়াডাঙ্গায় গত পাঁচ বছর ধরে পানের আবাদ বাড়েনি।

এসকে/সিবি/এডিবি/